উপসাগরীয় যুদ্ধের অব্যবহিত পরের কথা। মধ্যপ্রাচ্য তখন সরগরম আমেরিকা-ইরাক ইস্যুতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েতের পূনর্গঠন প্রয়োজন। এর জন্য চাই প্রচুর শ্রমিক। প্রচুর বিদেশী শ্রমিক, অভাব অনটনে থাকা তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক যাদের অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করানো যাবে। যারা তাদের সামর্থ্যের সেরাটা দিবে, এমন শ্রমিক চাই। সবদিক বিবেচনা করে উপমহাদেশের জোয়ান তরুণদের চাহিদা তুঙ্গে তখন মধ্যপ্রাচ্যে। জনশক্তি রপ্তানীর এজেন্টদের তখন রমরমা অবস্থা। লোকজন আসে, ইন্টারভিউ দেয়, মেডিক্যাল টেস্ট করায়, টাকা দিয়ে বাড়ি চলে যায়। "ভিসা লাগলে খবর দিমু নে"- এরকম কথার ওপর বিশ্বাস নিয়ে বাড়ি চলে আসে মধ্যপ্রাচ্য গমনে প্রত্যাশী তরুণ।
শফিকুল, চরম হতাশাগ্রস্ত একজন গ্রাম্য তরুণ। তেমন কিছুই করে না। তারা চার ভাই, দুইবোনের একজনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার বেশ কয়েক বিঘা কৃষি জমি আছে। মোটামুটি চলে যায় সারাবছর কৃষিকাজ করে। উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে কুয়েত পুনর্ঠনে যোগ দিতে সচেষ্ট হয় সে। এজেন্টের কাছে টাকা দেবার অভিপ্রায়ে বেঁচে দেয়া হয় তাদের কয়েক বিঘা জমির অনেকটা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, এজেন্টের কাছ থেকে "কালকেই ফ্লাইট" টাইপের একাধিকবার নাকানী-চুবানী খেয়ে যখন সে ম্রিয়মান ঠিক তখনই একদিন খবর আসে তার "ভিসা লেগেছে", কাল ভোরে ফ্লাইট, এক্ষুনী যেতে হবে।
গাঁয়ের সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় শফিকুল। পিছনে তার মা বড় রাস্তাটা পর্যন্ত আসেন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে। ছেলে বিদেশ চলে যাচ্ছে কতগুলো বছরের জন্য কে জানে, এই ভাবনা তাঁকে কুঁড়ে খেলেও শফিকুলের বাবা ভাবেন তখন অন্যকথা। জমি বেঁচে দেয়া টাকা, যদি কোন রকমে ফসকে যায় তাহলে সংসারের কী হবে!
মায়ের চোখের পানি, বাবার উদ্বিগ্ন চোখ, ভাইদের আশান্বিত দৃষ্টি সাথে করে শফিকুল অবশেষে কুয়েতগামী বিমানে চড়ে বসে। হ্যাঙ্গার থেকে বের হয়ে বিমান ট্যাক্সিং করছে এখন, শফিকুল জানালা গলে বাইরে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর ঝলমলে রোদ! আচ্ছা, ও যেখানে যাচ্ছে সেখানে কি এরকম সুন্দর, মনোরম, ঝলমলে রোদ উঠে? সেখানেও কি বিকেল বেলা দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাসে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া যায়? সেখানেও কি গোধূলী বেলাতে গোয়ালে গরু আনার তাড়া পরে যায়? সন্ধ্যা বেলায় কি সেখানেও কাটা ধান কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরে লোকজন, কারেন্ট চলে গেলে কি সেখাও বাড়ির সবাই উঠানে ওগলা পেতে বসে গল্পো করে? সেখানকার মানুষেরা কি অনেকদূরের গ্রামের কোন মানুষকে বিনা পরিচয়েই ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে প্রজন্ড গরম থেকে বাঁচতে একটা বাতাসার সাথে এক গ্লস পানি দেয়?
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শফিকুল। বিমান ততক্ষণে ট্যাক্সিং থেকে রানওয়েতে, টেকঅফ করার মুহূর্ত! জানালার কাঁচে হাত রেখে শফিকুল কেঁদে চলে অনবরত। হাতের স্পর্শে সে যেন বাইরের আলো, বাইরের বাতাস, বাইরের প্রকৃতিকে ছুঁতে চাচ্ছে কিংবা হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যেমনটা মানুষ করে অতিপ্রিয় কোন জিনিষকে ছেড়ে যাবার সময়!
সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। বাড়ি থেকে চিঠি আসে, চিঠি যায়। শফিকুল প্রতি চিঠিতেই জানতে চায় তার লাগানো জাম্বুরা গাছে জাম্বুরা ধরেছে কিনা, পুকুরের পাশের ডোবা এবর সেঁচা হলো কিনা, ইরির ফলন কেমন হলো এবার, পাশের বাড়ির রমুকাকা ছেলেপেলে নিয়ে এখনো কষ্ট করে কীনা, নিজের দাদী নেই, চাচাতো দাদীর বয়স হয়েছে যত্ন-আত্নির যেন কমতি নাহয় তার। এভাবেই সে চিঠি লিখে প্রতিবার, চিঠির সাথে পাঠিয়ে দেয় তার কষ্টের বেতনের থেকে বাঁচানো সিংহভাগের ব্যাংকড্রাফট!
শফিকুলদের বাড়িতে পাওয়ারলুম হয়েছে। সেখানে তার ভাইয়েরা কাজ করে। তাঁত বুনে, প্রতি মঙ্গলবারে সেই তাঁত তারা হাঁটে নিয়ে যায়, বেঁচে। বেড়ার ঘরের বদলে এখন ভিটপাকা চৌচালা হেছে শফিকুলদের। বড়ভাই বিয়ে করেছেন বছর খানেক হয়, বোনটার জন্য ভালো জায়গা থেকে সম্মন্ধ আসছে। মা চোখে দেখতেন না, ডাক্তার দেখিয়ে এখন চশমা নিয়েছেন। বাবাকে ভাইয়েরা রিটয়ারমেন্টে দিয়ে দিয়েছে "এখন আপনে আল্লা বিল্লা করেন" - এই বলে। সবই সুন্দর চলছে, সবকিছুই ঠিক। নিজের অজান্তেই শফিকুল একজন হিরো। তার পরিবারের সবার কাছে, তার চাচাতো দাদীর কাছে, তার রমুকাকার কাছে।
কিন্তু শফিকুল? সবাইকে ছেড়ে একা পড়ে আছে সুদূর মরুভূমিতে। হয়তো সে কাঠাফাটা রোদ্দুরে, দুপুরের কোন এক সময়ে হাড়ভাঙা খাটুনির ফাঁকে একটু বসে কোন জায়গায়। মাথা থেকে ময়লা লাগানো ক্যাপটা সরিয়ে ঘর্মাক্ত মুখটা ডানহাতের তালু দিয়ে মুছে উদাস দৃষ্টিতে ভাবে দেশে থাকার সেই দিনগুলোর কথা। নিজের গ্রামের কথা, সরষে ক্ষেতের আইল ধরে দৌড়ানোর কথা, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার কথা, মায়ের হাতের শোল মাছ দিয়ে গাছের প্রথম লাউয়ের ঝোল খাওয়ার কথা।
এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো একসময় ডাক পরে শফিকুলের, কাজে ফেরত যাবার ডাক!
অনিচ্ছা সত্বেও ময়লা ক্যাপটা মাথায় চাপায় শফিকুল। প্যান্ট গুটানো পা আবার শক্ত হয়ে ওঠে, না তার বিলম্ব করা উচিৎ হবে না একেবারেই। হিরোদের বিলম্ব করা মানায় না, হিরোদের থেমে গেলে চলে না। হিরো, আমাদের হিরো শফিকুলেরা!!
-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-।-
* একই সাথে হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত।
** যারা 'হাইলী লোস্পীড সিনড্রোমে' ভুগছেন তারা এখানে ট্রাই দিতে পারেন। ইউনিকোডে হাজারদুয়ারী
No comments:
Post a Comment