Friday, December 14, 2012

হ্যাকিং ঘটেছে কোন প্রান্তে?

উৎস: সচলায়তনে লিখেছেন হিমু প্রকাশিত হয়েছে: ১২ ডিসেম্বর ২০১২

উচ্চ আদালতের একজন বিচারক ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারার্থে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারক নিজামুল হক নাসিম ও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপিতে সাধিত কথোপকথন হ্যাক করে প্রকাশের ঘটনা এখন সকলেই জানেন। বিষয়টি গোচরে আনে যে পত্রিকাটি, সেই দি ইকোনমিস্ট এই হ্যাকড ম্যাটেরিয়াল নিয়ে টেলিফোনে একজন দায়িত্বাসীন বিচারকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে তার ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টাও করেছে। বিচারক পাল্টা আইনী ব্যবস্থার কথা রুল জারি করে তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম, যুক্তরাজ্যের দি ইকোনমিস্ট নিজেদের পত্রিকায় এ ব্যাপারে কোনো কিছু প্রকাশ না করে বানিয়ান শিরোনামে তাদের ব্লগে এ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত লেখা পোস্ট করে এবং প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশের দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় এই হ্যাকড কথোপকথনের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পত্রিকা ও ব্লগের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম বাংলাদেশী মিডিয়া সেটিকেই দি ইকোনমিস্টের "প্রতিবেদন" জ্ঞান করা শুরু করে এবং ব্লগটির বাংলা অনুবাদ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।


এ পর্যন্ত বিচারক ও আইনজ্ঞের মধ্যে কথোপকথন, স্কাইপিতে তাদের কথোপকথন হ্যাক করার সম্ভাব্যতা, ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে পত্রিকায় নানা কথা হয়েছে, কিন্তু উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের কথোপকথন হ্যাক করা কত বড় অপরাধ, এবং এই ধরনের অপরাধের বিচার বা শাস্তি প্রসঙ্গে আমাদের মিডিয়া মৌনীবাবার ভূমিকা নিয়েছে। আলোচ্য বিচারক ও আইনজ্ঞের কথোপকথন থেকে পরিষ্কার হয়, তাঁরা একটি সুগঠিত রায় ও সুচারু বিচারকাজের জন্য কী গভীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিজেদের ভেতরে লালন করেন। কিন্তু তাদের গোপনীয় আলাপ যারা আড়ি পেতে ধারণ করে প্রচার করলো, তাদের এই আড়ি পাতার কাজটি কতটুকু প্রসারিত, তা নিয়েও মিডিয়া চুপ। বিচারকের আলাপ যদি আড়ি পেতে শোনে কেউ, সে যে সাক্ষীদের গোপন রাখা পরিচয়ও হ্যাক করে কাজে লাগায়নি, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

কিছু সাক্ষী যে শেষ মুহূর্তে সাক্ষ্য দিতে নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়েছেন, সেটি থেকেও কি আমরা বুঝতে পারি না, এই সাক্ষীদের পরিচয় ফাঁস হয়েছে, এবং তাদের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে?

এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে সম্ভবত বিব্রত হবে সরকারের সেই অংশটিই, যাদের দায়িত্ব ছিলো গোপনীয় তথ্যকে গোপনীয় রাখা। আজ বিচারকের আলাপ হ্যাক হচ্ছে, কাল যে খোদ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির ফোন আলাপ হ্যাক হবে না, আমরা কীভাবে নিশ্চিত হবো? আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারার্থে গঠিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যদি হ্যাকিঙের শিকার হন, আর সেই হ্যাকিঙের বিচার চেয়ে মিডিয়াতে যদি কোনো প্রশ্ন না ওঠে, তাহলে কি এই সঙ্কেতই দেয়া হয় না, যে হ্যাকিংকে আমরা মেনে নিচ্ছি?

এই প্রশ্নগুলো ওঠার আগেই তাই অনলাইনে এই হ্যাকারদের প্রোপাগাণ্ডা অংশ অভিযোগের আঙুল তুলছে আইন বিশেষজ্ঞ ড. জিয়াউদ্দিনের দিকেই। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে কিছু কাঠবলদ ও পিতৃপায়ুজাত গর্ভস্রাব। তারা বলতে চায়, ড. জিয়াউদ্দিনই এই অডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ড. জিয়াউদ্দিন নিজেকে বিপন্ন করে এই বিচার প্রক্রিয়াকে কোন দুঃখে স্যাবোটাজ করতে যাবেন? আর নিরীহ আইনজ্ঞ জিয়াউদ্দিনকে যূপকাষ্ঠে চড়ালে কি বিচারককে গোপনীয়তা প্রদানে ব্যর্থ সরকারের বিশেষ কর্তাদের সদুত্তর দেয়ার খাটনি কমে যায়?

জামাতের প্রোপাগাণ্ডু মূর্খের দল নিজেদের অজান্তেই নিজেদের দাবির বিরুদ্ধে প্রমাণ তুলে দিয়েছে ইউটিউবে। যারা ইউটিউবে বিচারক ও আইনজ্ঞের মধ্যে কথোপকথন শুনেছেন, তারা পরিষ্কার খেয়াল করেছেন একটি ব্যাপার। এই অডিওতে ড. জিয়াউদ্দিনের কথা এসেছে কাটা কাটা, যেখানে বিচারকের কথা এসেছে পরিষ্কার। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের কচ্ছপগতির কারণে স্কাইপি বা গুগলটকে অপর প্রান্ত থেকে ভয়েস ডেটা আসে ভেঙে ভেঙে, যে কারণে কথা যান্ত্রিক শোনায়। বিচারকের কম্পিউটারে আড়ি পাতার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে বলেই সেখানে মন্থর নেটসংযোগের কারণে ড. জিয়াউদ্দিনের কথা এসেছে ভেঙে, আর সরাসরি মাইকে ধারণকৃত বিচারকের কথা স্পষ্ট শোনা গেছে। যদি ড. জিয়াউদ্দিনের প্রান্ত থেকে এই কথোপকথন রেকর্ড করা হতো, তার নিজের কথা কখনোই ভেঙে যেতো না। কথোপকথনের নমুনা এই পোস্টে দিচ্ছি না, কারণ উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের হ্যাক করা কথোপকথনের আংশিক বা পূর্ণাংশ পরিষ্কারভাবেই অবৈধ, এবং এর ব্যবহারের ওপর পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে আদালত থেকে। যার আগ্রহ আছে, তিনি ইন্টারনেটে জামাতের প্রোপাগাণ্ডুদের ছড়িয়ে দেয়া অডিও থেকে শুনে যাচাই করে দেখতে পারেন।

এই ঘটনায় দুটি অপরাধ সাধিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে দু'জন মানুষের কথোপকথন হ্যাক করা এবং সেই হ্যাক করা তথ্য প্রকাশ করা। এই দুটি অপরাধেরই আশু বিচার কামনা করছি। আমরা এই হ্যাকারদের পরিচয় জানতে চাই, শাস্তি চাই, আর এই হ্যাকড ম্যাটেরিয়াল যারা আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে প্রকাশ করলো, তাদের শাস্তি চাই।

যারা এই প্রসঙ্গে সংশয় বা দ্বিধায় ভুগছেন, জেনে রাখুন, আপনাদের সংশয়ই একাত্তরের ঘাতকদের শক্তি। ছাগুদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনের ময়দানে লড়াই করা একজন সহযোদ্ধা নিজের কানের চেয়ে ছাগু-প্রোপাগাণ্ডাকে বেশি মূল্য দিয়েছেন শুনে যেমন বিস্মিত হয়েছি, তেমনি আঘাতও পেয়েছি। আপনি একটা স্লো লাইনে বসে স্কাইপিতে বিদেশের কারো সাথে কি জীবনে কথা বলেন নাই? স্লোগান দিতে গিয়ে আমি বুঝতে শিখি, কে ভাই, কে দুশমন, গানটা তো আপনিও শুনেছেন। নাকি শোনেন নাই?

গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমায় ম্যাক্সিমাসের একটি সংলাপ আমার প্রিয়, সেটি দিয়েই শেষ করি। হোল্ড দ্য লাইন।

No comments: