Thursday, September 5, 2024

বেদনাদায়ক পনেরোই আগষ্ট

 

আমার সকল নিয়ে বসে আছি

সর্বনাশের আশায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


-তারেক মাহবুব

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ১৫ই আগস্ট , জাতীয় শোক দিবস সম্বন্ধে লিখতে বসে শতবর্ষ আগে কবি গুরুর লেখা এই গানটির কথা বার-বার মনে মনে পড়ছে।  রবির ভাষায়ই বলতে হয়, 'সাত কোটি বাঙালি হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।' পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসবায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কবিগুরুর এই পংক্তিটি উল্লেখ করে বলেছিলেন, “কবিগুরু আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেছে, আমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।"  আসলে কবিগুরু যে মিথ্যা হন নাই, বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে সেটা প্রমান করে গেছেন।

আজ আমি লজ্জিত, মৰ্মিত, এবং ভাষাহত।  নিজেকে বঙ্গসন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে বড় অসহায় এবং কলঙ্কিত মনে হচ্ছে।  আমরা কেউই কখনো ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করিনি, আর কখনো গ্রহণ করব বলে মনে হয় না।  অর্ধ শতাব্দী পূর্বে ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষটি নিজ জাতির সঠিক পরিচয়টি  মূল্যায়ন করতে যে ভুল করেছিলেন আজ এত বছর পরে এসে তার কন্যাও একই প্রকার ভুল ক'রে বাঙালি জাতিকে অকুল সমুদ্রে ভাসিয়ে গেলেন।

আজ আমি ভূতপূর্ব সরকার সম্মন্ধে খুব একটি আলোচনা করব না।  তাদের হিসাব-নিকাশ তারাই দেবেন, অন্যায় করলে তার বিচার হবে। আমার প্রশ্ন হল বঙ্গবন্ধুকে অপমান ক'রে আজ আমরা নিজেদের চরম দৈনতার পরিচয় দিয়েছি।  যে মানুষটি আজ সবুজ বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাষ্টে এসে নীল পাসপোর্টধারী হয়েছে, সে হয়ত ভুলে গেছে বঙ্গবন্ধু না থাকলে ওই সবুজ পাসপোর্টটি থাকত না।  যে ছেলেটি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এর উপরে উঠে বীরত্ব প্রকাশ করছে, সেই মহামানবটি না থাকলে হয়ত পাকিস্তানের কোন এক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে পড়ালেখা করতে হত।  তাকে তখন আর কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হত না, কোটার জন্য আন্দোলন করতে হত, আর সেই আন্দোলনের মূল বিষয় হোত পূর্ব পাকস্তানীদের জন্য কোটা চাই। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর কোন প্রাইভেট সম্পত্তি নয়, ওটা জাতীয় সম্পদ। পাকিস্তান নামের জানোয়ারগুলোও সেই বাসা অক্ষত রেখেছিল, আমরা বাঙালীরা সেটা ধ্বংস করে দিলাম। এই লজ্জা রাখি কোথায়।  বঙ্গবন্ধু কোন একক দলের নেতা না, উনি সমগ্র জাতির নেতা।

আজ শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের জন্য যদি বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করা হয়, তাহলে তো মুসলিমদের বিভিন্ন ব্যার্থতা ও অপকর্মের জন্য নবী মোহাম্মদকে দোষ দিলে সেটা কি কোন অন্যায় হবে? বাংলার ইতিহাসে আজ পর্যন্ত্য সব সরকারই ক্ষমতা থেকে পালা বদলের পর স্বৈরাচারের তকমা গায়ে লাগিয়েছে। যখন কেউ বলে শেখ হাসিনার হাতে রক্ত তখন তারা ভুলে যায় ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার কথা।  খন্ডকালীন স্বরাষ্ট উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাহেব যেদিন বললেন যে গুলিতে মানুষ মারা গিয়েছে সেই ৭১ ক্যালিবারের রাইফেল বাংলাদেশের কোন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে না বা তাদের হাতে সেই অস্ত্র নেই।  কয়েকদিন পরেই দেখলাম তাঁকে স্বরাষ্ট উপদেষ্টা থেকে বদলি করে পাট ও বস্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়েছে।  আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্য বিরোধীতার জন্য এবং স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীদের দাবী আগেকার প্রশাসনের সময়ে কথা বলতে দেওয়া হোত না।  তবে এখন কেন ১৫ আগস্টে ৩২ নম্বরে যেতে দেওয়া হল না। কারো ইচ্ছা হ'লে সেখানে যাবে, তাকে বাধা দেওয়া কি স্বৈর শাসনের মধ্যে পরে না।

প্রতিবেশী দেশে মহাত্মা গান্ধীকে অসম্মান করার মত দুঃসাহস বিজেপি বা আরএসএসের মত ডানপন্থী, হিন্দু জাতীয়তাবাদীও দেখায়নি। কারন তারা জানে গান্ধী শুধু কংগ্রেসের নেতা নন, উনি সমগ্র ভারতবর্ষের নেতা।  জীবনের প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বহুদিন কাটিয়ে এসেছি। সেখানে প্রত্যেকটি দেশে বিশালাকৃতির রাজার ছবি বিভিন্ন সরকারি ভবনের বাইরে বিরাজমান।  এজন্য কারো কোন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। যত ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত  আমাদের মধ্যে। অথচ নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত এক হেফাজতি নেতা হঠাৎ জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সুযোগ বুঝে কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেছে।  কি অদ্ভুত এই দেশ এবং ততোধিক অদ্ভুত ধর্মীয় নেতারা। ইসলামিক আইন মানতে হলে তাকে অর্ধেক মাটিতে পুঁতে পাথর মেরে হত্যা করার রীতিমত নির্দেশ আছে।

 শুধু এই ঘটনাগুলিই নয়, কান পাতলেই  শুনতে পাই সুন্নীরা বলবে "শিয়া" বা 'খারাজী"  মুসলিম না।  ওদেরকে নন-মুসলিম হিসাবে ঘোষণা দেবার দাবী তুলে তাদের পবিত্র কোরান শরীফ পর্য্যন্ত পড়তে বাঁধা দেয়। অপর পক্ষে শিয়ারা বলবে সুন্নিরা মুসলিম না। হুজুররা তো কথায়-কথায় বলে ৯০% মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ।  এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে  এই শিয়া, আহমদিয়া, কাদিয়ানী, বা খারেজীরা কি ওই ৯০% এর  মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? ওদেরকে বাদ দিলে আদৌ কি ৯০% থাকেযতক্ষণ হিন্দু আছে ততক্ষনই আমরা মুসলিম। ওদের তাড়ালেই আমরা শিয়া, সুন্নী, ওয়াহাবি, সালাফি, হানাফী, কাদিয়ানী, আহলে হাদিস, মাজারি, কওমী, ফুলতলী, ফুরফুরী, আটরশি, মাইজভাণ্ডারী হয়ে যাব।" এরা সবাই একে অপরকে কাফের হিসাবে গণ্য করবে

মনে পড়ে আফগানিস্তানের কথা, ৭০ দশকে দেশটি একটি উদীয়মান জাতি হিসাবে পরিচিতি ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা আফগানিস্তান ভ্রমণের বই থেকে শুরু ক'রে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের তথ্য থেকে জানা যাই সেকুলার আফগানিস্তানের কথা। একটি প্রগতিশীল জাতি কিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তার বাস্তব উধাহরন আফগানিস্তান, আর পাকিস্তান নামের দেশটি অনেক আগে থেকেই দেউলিয়া হয়ে বসে আছে।  আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বলে বাংলাদেশ অতি দ্রুততম সময়ে সেই পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোন এক বিখ্যাত মনীষী বলে গেছেন , "কথা ছিল ধর্ম মানুষকে রক্ষা করিবে, যেদিন থেকে মানুষ ধর্মকে রক্ষা করা শুরু করিল সেদিন থেকে গন্ডগোল শুরু হইল"।  



No comments: