বাঙালি আড্ডাগুলো আমার খুবই অপছন্দের। প্রায় একই ধরণের ঘ্যান ঘ্যানে ও ঘিন ঘিনে আলাপের চল সেখানে। শুরুতে দুয়েকটা আড্ডায় আগ্রহ ভরে গিয়েছিলাম, এবং তখনকার অভিজ্ঞতা থেকে মনে মনে কান ধরেছি, বাপু হে, আর নয়। এইবার ক্ষ্যান্ত দাও।
আড্ডাগুলোর যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে অপছন্দ, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এলেই দেখা যায় সবাই চরম হতাশাবাদী হয়ে উঠেছে। নাক কুচকে ভুরু বাঁকিয়ে কাঁধ নাড়িয়ে সবাই উদাস গলায় বলে, নাহ, এই দেশ দিয়ে কিছু হবে না।
আমি তখন গলা নরম করে জিজ্ঞেস করি, কেন হবে না বলুনতো, কি মনে হয় আপনার? কোথায় সমস্যা?
এরকম সরাসরি জিজ্ঞাসায় বক্তা সাধারণত একটু বিহবল হয়ে যান। এদিক ওদিক তাকিয়ে দুয়েকজন সমর্থক খোঁজার চেষ্টা করেন। কারণ সম্ভবত আর কোন আড্ডায় এরকম হতাশ দীর্ঘশ্বাসের পরে তাকে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নি। অন্য যারা দীর্ঘশ্বাস রেডি করেছিলেন, তারা সম্ভবত আমার আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি দেখে সেগুলো আর বেরুতে দেন না, আটকে ফেলেন। আর মূল বক্তা তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন, না, এই যে দেখেন, চারিদিকে সন্ত্রাস, দূর্নীতি জীবনের নিরাপত্তা নেই, এরকম হলে একটা দেশ কেমন করে উঠবে বলেন? দেখেন আমাদের পাশের দেশ সিঙাপুর, মালয়েশিয়া ওরা কত উন্নতি করে ফেললো তর তর করে...।
অন্য কোন দেশের সাথে তুলনা চলে এলেই আমার রাগ হয় খুব। সিঙাপুর বা মালয়েশিয়ার ইতিহাসের সাথে আমাদের মিল নেই। বাঙালি জাতিই একটা মিশ্র জাতি। যুগে যুগে নানাদেশের নানান রকম মানুষ সম্পদের লোভে এইখানে এসে বসতি গড়েছিলো, তখন থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের রক্তে মিশ্রণ শুরু হয়ে গেছে। আজ এতদিন বাদে যদি তাকাই তো দেখি বাঙালি কারো সাথে কারো চেহারায় মিল নেই। একেকজনের চেহারার গঠন বা বৈশিষ্ঠ একেকরকম। এবং আমি নিশ্চিত যে বাইরের চেহারার সাথে সাথে তাদের মনের গঠনেও রয়েছে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র! ঠিক এরকম একটা মিশ্র ইতিহাস সাথে করে নিয়ে একটা জাতিকে “এক'' হয়ে উঠতেই বিস্তর সময়ের প্রয়োজন। আমরা কি আদৌ সেই সময়টা পেয়েছি? আমার মনে হয় না।
খুব সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে অবশ্য নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইস্যুতে আমরা একসাথে গর্জে উঠেছি ঠিক। ৫২, ৬৯, ৭১ বা ৯০- এ সবই সেসবের একেকটা বহি:প্রকাশ। এবং আমি মনে করি, ভেতর ও বাইরের এরকম বিভিন্নতা ভুলে কিছু সময়ের জন্যে এক হয়ে যাবার যে প্রবণতা- তার সুফলও আমরা হাতে নাতেই পেয়েছি- নিজেদের ভূখন্ডের স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা, পেয়েছি নিজেদের ভাষার অধিকার। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে না যে আমাদের “হবে''- বাংলাদেশের কিছুই হবে না নয়, বাংলাদেশের অনেক কিছুই হবে?
সঠিক নেতৃত্ব না আসার দূর্ভাগ্যও আমাদের উন্নতিতে দেরি হবার ( উন্নতি না হবার- কথাটা ভুল বলে মনে করি আমি ) পেছনের একটা বড় কারণ। আমাদের স্বভাবের মাঝেই অসততা বা দূর্ন ীতি ঢুকে বসে আছে- এরকম কোন ধারণাও ভুল। ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান সারা দেশের মানুষের সমর্থন পেয়েছে। দূর্ন ীতিবাজ রাজনৈতিক নেতাদের ঢালাও গ্রেফতারেও সাধারণ মানুষ খুশি। যে কোন ভালো উদ্যোগেই দেশের মানুষ নিজের সবটুকু শ্রম দেয়। অমিত নামের ছোট্ট ছেলেটির জন্যে সারা দেশের মানুষের নি:স্বার্থ ভালোবাসার কথা আমরা ভুলে যাই নি। ব্লগের এ ছোট্ট পরিসরেও যখন প্রাপ্তির কথা উঠলো, প্রায় সবাই তার সাধ্যমতোন চেষ্টা করেছে। প্রথম আলোর মঙ্গাপীড়িতদের জন্যে অথবা এসিডদগ্ধদের জন্যে যে তহবিল সেখানে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এবং দেখা যাচ্ছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই সেখানে বড় অংকের টাকা জমা দিচ্ছেন। যার মানে হলো, তাদের অনেকেই মন থেকে সেবা করার উদ্দেশ্যেই দান করছেন।
এসবই আমাদের মনের ভেতরকার ভালোত্বের প্রকাশ। যত দিন যাবে, ছোট ছোট ভালো গুণ মিলিয়ে আমরা আমাদের হৃদয়টাকে অনেক বড় করে তুলবো অবশ্যই, আমাদের বাঙালি হৃদয়ও তখন পরিচিত হবে সৎ ও দূর্ন ীতি বিরোধি হিসেবে।
কিছু সৎ নেতৃত্ব দরকার আমাদের, কিছু শক্ত আইন দরকার, সেই আইন রক্ষার জন্যে দরকার কিছু নিষ্ঠাবান প্রশাসক। এবং আমার ধারণা, এই চাওয়াগুলো আকাশকুসুম কোন কল্পনা নয়। এসবই সম্ভব। পঁয়ত্রিশ বছর গিয়েছে, জানি এটা অনেক সময়, আমরা হয়তো একটু লেট লতিফই হলাম। পঁয়ত্রিশে পারি নি, সত্তরে হোক!
আমি বরং খুব নিকট ভবিষ্যতে খুব সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখতে পাই। আমাদের বয়েসী যারা আছে, আমাদের সমমনা বন্ধুরা, আমি তাদের অনেকের মাঝেই দেশের জন্যে অপরিসীম ভালোবাসা দেখেছি। সৎ জীবন যাপনের অঙ্গীকার দেখেছি। আমি জানি, এরকম মানুষের সংখ্যা হয়তো এখনো অনেক কম, কিëতু সেটা একসময় বাড়বে নিশ্চয়। আমাদের এ আশাবাদী চিন্তাগুলো যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি সবার মধ্যে, যারা হতাশায় কেবলই মাথা নাড়েন, তাদের মাথাটাকে শক্ত করে চেপে ধরে যদি বলি, দেখুন, বাংলাদেশের উন্নতি হবে, খুব তাড়াতাড়িই হবে যদি আপনি মাথা নাড়ানো থামিয়ে দেশের জন্যে একটা ভালো কিছু করার সংকল্প করেন, তবেই সেটা সম্ভব।
হতাশাবাদীদের মুখে ঝাঁটার বাড়ি, আমি ভাই সারাজীবনই আমার দেশ নিয়ে আশাবাদীদের দলে। আপনি?
No comments:
Post a Comment