Wednesday, March 28, 2007

প্রজন্মের ইতিহাস পাঠ-চর্চা এবং রাজনীতি

হয়তো নিয়মটাই এমন - সবাই নিজের একটি আইডেন্টিটি খুঁজে। একাত্তরে যুদ্ধ করা মানুষরা আমাদের সামনে এক উজ্জ্বল তারকাপুঞ্জ! একজন মুক্তিযোদ্ধার হাত ছুঁয়ে টের পাই নিজের ভেতরে রক্তের তাপীয় বুদবুদ। কিংবা আরো পরে কিছু মুখ এসে বিষ্ময় জাগিয়ে যায়। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের গমগমে কবিতার পংক্তিমালা আনে গণতন্ত্রের বাতাস। বুঝি - তারা সবাই একটি প্রজন্মের উত্তরসূরী। এরকম প্রতিটি প্রজন্ম এগিয়ে যায় সামনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। প্রেরণা দেয় ইতিহাস, প্রেরণা দেয় রাজনীতি।

সময়ের দাবিতে প্রতিবাদী হাতগুলো জড়ো হয় সুন্দরের শপথে। তবুও ইদানিং কেমন জানি দলছুট মনে হয়। কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনে রাজনীতির নিষিদ্ধ দীক্ষা দেন গুরুজনেরা। কিশোর কিশোর ভাব নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। বাবা-মা খুঁজে বের করেন - 'রাজনীতি ও ধুমপানমুক্ত কলেজ'। প্রতিনিয়ত উপদেশ পাই- কী কী থেকে মুক্ত থাকতে হবে। রাজনীতির মতো 'খারাপ জিনিস' থেকে দূরে থাকি, মাঝে দুয়েকবার সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়ালেও তিতা স্বাদে ফেলে দিই। মনে হয় - রাজনীতিও বুঝি সেরকম ব্যাপার।

আরো পরে, গুরুজনেরা আলাপ করেন - 'রাজনীতি দেশটা শেষ করে দিলো। ছাত্র রাজনীতি আরো খারাপ। কী হয়, ভার্সিটিগুলোয় পড়ালেখা হয়! খালি মারামারি, গোলাগুলি।'শুনে চমক লাগে। জ্বীন-পরীও ভূত-প্রেতের গল্প সত্যি হয়ে আসে। বর্গী আসার আগেই ঘুমোতে হবে। খাজনা দেয়ার দিন এখন নেই। দেশের জনপ্রিয়তম লেখকটি তখন টিভির টকশো-তে বলেন - 'স্বাধীন দেশে ছাত্র রাজনীতির দরকার নেই।' আসলেই তো! কী দরকার! আমরা এখন স্বাধীন, কার জন্যই রাজনীতি করবো।

আমি ঘুমাই, বন্ধুরা ঘুমায়। খোকা ঘুমায়। পাড়াও হয়তো জুড়ায়। ঘুমায় ইতিহাস চর্চা।এর মাঝে দেয়াল লিখন পাল্টায়। পাল্টায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। গোলমেলে টিকটিকিও ভাষা সৈনিক হয়ে উঠে। টের পাই না, এরাই একাত্তরের কীট!আমরা তখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। স্যরি, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কারিকুলামে ছিল না। আমি মার্কেটিংয়ের ছাত্র, আমার বন্ধুরা ফাইন্যান্সের। কেউ বা সাহিত্যের, ভূগোলের কিংবা সায়েন্সের। ইতিহাসের পড়ুয়ারা মাথা চুলকে বলে -

জিয়াউর রহমানই তো স্বাধীনতার ঘোষক! তাই না?
আসলেই!
ধ্যাত - এগুলো তো জেনারেল নলেজ। কেনো! আমরা ক্লাস ফাইভে পড়লাম না?
রাইট। রাইট।
একাত্তরে তিরিশ লাখ মারা গিয়েছিল নাকি, আসলে ওটা হবে তিন লাখ।
কারা কারা জানি - তিন লাখকে ভুলে থ্রি-মিলিয়ন বলেছিল।
ঠিক, ঠিক। তিন লাখ।

আমরা আবার ঘুমাতে যাই। আমাদের বিবেকও ঘুমায়।
জেগে থাকে কীট প্রতঙ্গ। ওরা ধীরে ধীরে দানব হয়ে উঠে।

আমরা কচ্ছপের মতো মাথা লুকাই, সুযোগ বুঝে বের হবো।
অথচ ঐ সুযোগ আর আসে না।
আমাদের ঘুমে এবং জাগরণে তখন দানবের রাজত্ব।
আমরা হয়ে উঠি - দানব প্রজন্ম।

(হাজারদুরারী-তে প্রকাশিত)

No comments: