Monday, November 26, 2007

পাকিস্তানই এখন পাকিস্তানের বৈরীপক্ষ

পাকিস্তানই এখন পাকিস্তানের বৈরীপক্ষ
অনিরুদ্ধ আহমেদ


এক
পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করলে বোধ হয় ভুল বলা হবে না। টেলিভিশনের মিনি পর্দায় দেশটির সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মুশাররফের হতাশ চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিল, পাকিস্তান এক দারুণ দুর্দিন অতিক্রম করছে । তিনি যে হতাশা প্রকাশ করেছেন , জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর তাঁর ভাষণে, সেটি যে কোন দেশের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির জন্যে লজ্জার বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা কেবল স্বপ্ন নয়, বলা যায় দুঃস্বপ্নের চেয়ে ও কঠিন বিষয়। এই বাস্তবতা উপলব্ধির জন্যে সেখানে জরুরী অবস্থা ঘোষণার কারণে গণতন্ত্র খর্ব হয়েছে বলে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন কিংবা অনুচ্চারিত প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাঁদের সর্ব প্রথম সেই ভ্রান্ত আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যেখানে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে একটা সমীকরণ সাধন করা হয়েছে এবং একটিকে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রায়োগিক সমস্যার অন্তরালে রয়েছে একটি তাত্বিক সমস্যা। রাষ্ট্রটির সংজ্ঞা নির্ধারণে সজ্ঞানে যে ভ্রান্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন পাক প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্না, তারই প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক অস্তিত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে বার বার। অবশ্য পরবর্তী ঐতিহাসিকরা এটি প্রমাণ করেছেন যে জিন্না নিজেই ইসলামি শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন না এবং তাঁর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিটুকু তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে । পরম পরিহাসের কথা এই যে গণতন্ত্রের চেয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব রাই যে বড় কথা সে কথা স্বীকার করেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ ও। বিলম্বে হলেও শরীফের এই উপলব্ধি বাস্তবসম্মত। তবে নেওয়াজ শরীফ সম্ভবত ভুলে গেছেন যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত এই ব্যক্তি ও তাঁর দল ক্ষমতাচ্যুত হবার আগে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আক্রমণ চালিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে । এবার ও সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট জেনারেল মুশাররফ আদালতের টুটি চেপে ধরলেন সম্ভবত এই আশঙ্কায় যে ঊর্দি পরা অবস্থায় তাঁর নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আদালত অবৈধ ঘোষণা করবে।

দূর্ভাগ্যের কথা এই যে পাকিস্তানে আদালতের রায় যখনই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে গেছে কিংবা যাবার সম্ভাবনা হয়েছে তখনই আদালত ও বিচারক সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন, আইনকে তাঁর নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হয়নি। এবারের জরুরী অবস্থা ঘোষণা যাকে বেনজির প্রথমে সামরিক শাসন জারি এবং পরে মুশাররফের "দ্বিতীয় অভূত্থান" বলে অভিহিত করেছেন তার একটি প্রধান টার্গেট হচ্ছে এই আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা। পাকিস্তানে বহুবার জরুরী অবস্থা আরোপ করা হয়েছে, সেই ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জার সময় থেকে কিন্তু কখনই সেখানকার বিচার ব্যবস্থা ও বিচারকদের এ রকম অবমাননা করা হয়নি যেমনটি এবার করা হলো। পাকিস্তনে আইনের শাসনের প্রতি প্রশাসকদের এই অনীহা এমন এক সময়ে প্রদর্শিত হলো, যখন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল এবং তা ও জরুরী অবস্থার আওতার মধ্যেই। বাঙালিরা এ ব্যাপারে সহজেই গর্বিত বোধ করতে পারেন যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, আমাদের জনগোষ্ঠির মধ্যে এমন এক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে যা নানান প্রতিকুলতার মধ্যেও আমাদের গণতান্ত্রিক দাবী থেকে বিচ্যূত করতে পারেনি। আর বাংলাদেশে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা এসছে তা মূলত এই গণতান্ত্রিক চেতনার কারণেই।

দুই
পাকিস্তানে এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব আমরা লক্ষ্য করেছি একেবারে গোড়া থেকে। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা, যাঁর উল্টো দিকে দৌঁড়ানোর ঘটনাকে দীর্ঘ দিন আমাদের ছোট বেলায় জিন্নার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়েছিল, তিনি যে বাস্তবেও গোটা দেশকে উল্টো দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সে কথা বোঝা গিয়েছিল সেই ১৯৪৭-৪৮ এ ও। যদি ও ভারত বিভাজনের জন্যে জিন্নার মতো নেহরু ও দায়ী এবং তদানীন্তন ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহম বোধ এর সঙ্গে মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠতার হীনমন্যতা বোধ একত্রিত হয়ে ভারতকে বিভাজন করেছিল কিন্তু একেবারে গোড়া থেকে মি জিন্না যে ভাবে পাকিস্তানে বাঙালি নেতাদের খর্ব করেছিলেন, বাংলা ভাষাকে করেছিলেন অবমূল্যায়িত এবং নিজে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ না করে দেশের গভর্ণর জেনারেল পদ গ্রহণ করেছিলেন, আইন পরিষদে বাঙালিদের বক্তব্যকে সম্পুর্ণ অগ্রাহ্য করেছিলেন, তাতে জিন্না তাঁর পশ্চিমে শেখা গণতন্ত্র ও মুক্তির মনোভাবকে প্রকারান্তরে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠি স্বার্থে। এর পর পাকিস্তানে একের পর এক গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হয়েছে, ১৯৭১ সাল এই লঙ্ঘনের এক চরম দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ্য করি যেখানে একটি জাতিসত্বাকে অবদমনের জন্যে পাকিস্তানি শাসকরা কি ধরণের নিপীড়ন চালিয়েছিল তার ইতিহাস সকলেরই জানা। কিন্তু ১৯৭১ এ‘ই থেমে যায়নি পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । জিয়াউল হকের মতা গ্রহণ, জুলফিকার আলী ভুট্ট্রোর ফাঁসি, বেনজির ও নেওয়াজ শরীফের দূর্নীতিগ্রস্হ কথিত গণতন্ত্র এবং বিমানের ভেতরে বসে মুশাররফের নাটকীয় অভূত্থান।

তিন
পাকিস্তানে এখন সব চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই উগ্রপন্থিরা যারা পাকিস্তানে তালেবানী ধরণের কট্টর শারিয়া আইনের বাস্তবায়ন চায়। যে ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান বার বার তার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছে, কী কাশ্মীরে, কী বাংলাদেশে, সেই ইসলামি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবীই এখন পাকিস্তানের জন্যে আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে, পাকিস্তানের অস্তিত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। যে আদর্শের বাহ্যিক ঘোষণা পাকিস্তানের জন্মের মূল কারণ সেই আদর্শের প্রায়োগিক রূপায়ন যে দেশটির মৃত্যুর কারণ ও হতে পারে সে কথা ক্রমশই পরিস্কার হয়ে উঠছে। মুশাররফ তাঁর ভাষণে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী আক্রমণের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন পাকিস্তানের নিজেরই আত্মহননের আশঙ্কার কথা। যে ফ্রাঙ্কেস্টাইনকে পাকিস্তান লালন করেছে, কখনও ভারতের বিরুদ্ধে, কখনো প্রতিবেশী আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, সেটি এখন এমন এক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে যে তা গোটা পাকিস্তানকেই গিলে ফেলতে পারে। মুশাররফের জরুরী অবস্থা ঘোষণা কেবল মাত্র এক ধরণের প্রবঞ্চনাই বটে কারণ ইসলামি জঙ্গিদের দমন করার ব্যাপারে তাঁর কোন পদপেই সফল হয়নি তেমন একটা। আসলে সেই প্রচেষ্টার কতখানি আন্তরিক সে নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন আছে বিস্তর । যে উগ্রপন্থিদের শায়েস্তা করার প্রত্যয় প্রকাশ করে মুশাররফ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতকে গৌন করে তুললেন সেই মৌলবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তাঁর জরুরী অবস্থার প্রতিক্রিয়া আদৌ হয়েছে কী না সে নিয়ে সন্দেহ । বরঞ্চ জঙ্গিবাদের যুৎসই অজুহাত দিয়ে একদিকে তিনি পশ্চিমের মনোরঞ্জন করছেন, আরেকদিকে নিজের দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে দূর্বলতর করে তুলছেন । আর এর ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রবিরোধী উগ্র শক্তিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সে জন্যেই ল্য করি যে মুশাররফের জরুরী অবস্থায়, যাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তারা কিন্তু বোমা বন্দুক বহনকারী কোন সন্ত্রাসী শক্তি নয় ; তারা সেই সুশীল সমাজের অংশ যারা যুক্তি দিয়ে শক্তিকে খর্ব করে। সে জন্যেই যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখি যে সাদা পোশাকধারী মুশাররফের পেটুয়াবাহিনী চ্যাঙ্গদোলা করে, আইনবিদদের নিয়ে যাচ্ছে কারা-যানের দিকে , তখন বুঝতে আর কারও বাকী থাকে না যে মুশাররফের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা আসলে কাদের বিরুদ্ধে ? কিন্তু জেনারেল মুশাররফ এ কথা জানেন নিশ্চয়ই যে এই সব উদার মনস্ক ব্যক্তি পাকিস্তানের শত্র“ নন, তাঁরা চান পাকিস্তান মোল্লাতন্ত্রের কবল থেকে বেরিয়ে এসে একটি আধুনিক যুক্তিবাদী সমাজের অংশ হোক। স্থায়ী ভাইরাসের মতো ভারত বিরোধীতার যে জিগির পাকিস্তানকে ভেতর থেকে দূর্বল করেছে বার বার তা থেকে পাকিস্তানের মুক্তি ঘটুক বিশ্বায়নের এই সময়টাতে। মুশাররফ নিজেও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের তত্ব কথা কপচিয়েছেন বার বার কিন্তু প্রকৃত অর্থে মনে হয় যেন তিনি ও সেই ইসলামি মৌলবাদীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন যারা পাকিস্তানকে তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্যে জিহাদি মনোবৃত্তি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন। বস্তুত মুশাররফ যে অভ্যন্তরীণ এবং বহির্দেশীয় চাপের মুখে আছেন সে কথা বলাই বাহুল্য । আল কায়দা ও তালেবান খেদানোর যে ব্রত তিনি পশ্চিমে প্রকাশ করেছেন তার পুর্ব শর্ত হিসেবে দেশে যে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে, তাকে তিনি আবার রুদ্ধ করছেন। গৃহস্থকে বলছেন সাবধান থাকতে, চোরকে বলছেন চুরি করতে। জেনারেল মুশাররফের এই দ্বৈত ভুমিকা তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে যেমন কমিয়ে এনেছে, তেমনি পাকিস্তান আধুনিক বিশ্বের জন্যে কতখানি বিশ্ব¯ত্ব হতে পারবে সেটা ও এখন প্রশ্নসাপে হয়ে পড়েছে। মুশাররফের আনুগত্য কি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের পেছনে, নাকি মতায় টিকে থাকার জন্যে জঙ্গিদের সঙ্গে আপোষ করার দিকে, সে জিজ্ঞাসা ও সকলের।

চার
পাকিস্তানের জন্যে ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সৈন্যরা এখন প্রাণ দিচ্ছে ইসলামি আদর্শ কায়েমের জন্যে যারা জিহাদ করছে, তাদেরই হাতে। এটাকে আত্মহনন ছাড়া আর কী বা বলা যায়। কিন্তু কে সৃষ্টি করলো এই বিপুল শক্তিশালি ফ্রাঙ্কেস্টাইন। বস্তুত এর তাত্বিক সমর্থন বরার্বই ছিল পাকিস্তানে ধর্ম ভিত্তিক, ভারত বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেই কিন্তু এর প্রত্য প্রকাশ ঘটে জিয়াউল হকের আমলে মুজাহিদ সৃষ্টির মাধ্যমে যারা তদনীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের কবল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করাতে এক ধরণের "জিহাদ" এ অংশ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ও প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল এই মুজাহিদ সৃষ্টির পেছনে, সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরোধীতার জন্যে ঐ প্রায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত আফগানিস্তানে ইসলামের জিগির তুলে এই মুজাহিদরা সোভিয়েট ইউনিয়নকে বিতাড়িত করতে সফল হয় বটে কিন্তু আফগানিস্তানসহ ঐ অঞ্চলের একটা স্থায়ী ঘাঁটি হয়ে যায় দ্রুত। মুজাহিদ, তালেবান ও আল ক্বায়দার সংমিশ্রণে যে শক্তিশালী ইসলামি জঙ্গিবাদের জন্ম হয় তা গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্যে হয়ে ওঠে এক বড় চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানও নিজের স্বার্থে এই কট্টর ইসলাম পন্থিদের লালন করে, গোপনে ভারতীয় কাশ্মিরে আক্রমণের জন্যে এই সব মুজাহিদদের ব্যবহার ও করেছে পাকিস্তানের সরকার। ভারতে একাধিক জঙ্গি হামলার জন্যে দায়ী এই সব ইসলামি পন্থি উগ্র সংগঠনগুলো যারা পাকিস্তানের আদর্শের মধ্য দিয়ে তাদের মানসিক খাদ্য গ্রহণ করেছে এবং ক্রমশই পরিপুষ্ট হয়েছে সেই খাদ্যে । মুশাররফের জরুরী অবস্থা ঘোষণায়, সেই পরিস্থিতিতে আদৌ কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এই সমস্যার কোন শান্তিপূর্ণ সমাধান আদৌ সম্ভব বলে মনে হয় না। এর প্রধান কারণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তার গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে যে ইসলামি উগ্রবাদ বিরাজ করছে তাকে, মুশাররফের সদিচ্ছা থাকলেও, বিতাড়িত করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান যে এই জঙ্গিবাদকে কেবল মাত্র ভারত ও বাংলাদেশে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাচার করেছে তাই-ই নয়, নিজেদের দেশেও কথিত শারিয়া আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টায় এখনও সংগ্রাম করছে। মুশাররফ এই মৌলবাদিদের মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছেন । হুদুদ আইন রদ করতে তিনি খানিকটা সফল হয়েছেন কিন্তু পাকিস্তানের মাদ্রসাগুলো তাদের অর্থায়নের সুত্র জানানোর ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছে। রাজধানী ইসলামাবাদের লাল মসজিদই বলুন , আর সোয়াত উপত্যকায় মাওলানা ফয়জুল্লাহর অনুগামিদের কথাই বলুন, সব ক্ষেত্রেই বিপুল রক্তপাত ঘটেছে, পাকিস্তানি সেনাদের এমন হত্যাকান্ড, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া আর কখনই ঘটেনি।

পাঁচ
অনুমান করা যায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই ইস্যুতে আলম্বিক বিভাজিত। একটি বৃহৎ অংশই যারা কট্টর ইসলামের প্রতি অনুগত তারা এক পর্যায়ে এই তালেবান সমর্থকদের হত্যা করতে অপরাগতা প্রকাশ করতে পারে এবং তখন সেটা হবে পাকিস্তানের জন্যে সত্যি সত্যি আত্মঘাতী। যদি পাকিস্তানের প্রশাসন ব্যবস্থা তালেবানদের হাতে চলে যায় , তা হলে পারমানবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ এই রাষ্ট্রের মৌলবাদীরা ইরানের চেয়েও ভয়াবহ হবে বিশ্বের জন্যে। এই উপলব্ধিতে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থি বারাক ওবামা আগে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন। কথাটি খুব তিক্ত হলেও সত্যি। কারণ পাকিস্তানের উগ্র জঙ্গি শক্তির হাতে ঐ মরানাস্ত্র চলে গেলে গেলে তা বিশ্বের জন্যে দূর্যোগ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অপর অংশ, যারা মুশাররফের প্রতি অনুগত এখনও, তারা এতখানি কট্টরপন্থি নয় তবে বলাই বাহুল্য তারা ও গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান বিরোধী। তারা মুশাররফের মতোই নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে রেখে, উগ্রপন্থিদের প্রতি নরম গরম আচরণ চালিয়ে যেতে চায়। এই ব্যবস্থা যে আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হবে, এখনকার উগ্রবাদী লক্ষণ দেখে তা মনে হয় না।

পাকিস্তানে রাজনৈতিক শুণ্যতা, সেনাবাহিনীর বিভাজন, পারমানবিক অস্ত্র প্রসারের আশঙ্কা এ সব কিছু পাকিস্তানকে কেবল দণি এশিয়া নয়, বিশ্বের একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। যদিও এ জন্যে পাকিস্তানের সাধারণ জনগোষ্ঠি, সেখানকার প্রগতিশীল সুশীল সমাজ দায়ী নন কিন্তু তাঁরা ও এই উগ্র শক্তির হাতে বন্দী হয়ে যেতে পারেন। পাকিস্তানের সুশীল সমাজের সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো, একদিকে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ে তাঁদের সামরিক বাহিনীর ক্ষোভের শিকার হতে হয়, অন্য দিকে উগ্র ইসলামপন্থিদের বর্ধিষ্ণু শক্তি তাদের জন্যে চ্যালেঞ্জে হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ সব সত্বেও এই সুশীল সমাজকেই জেগে উঠতে হবে, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিকে ও সুশীল সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানের জীর্ণ পুরাতন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি জনিত আদর্শকে পরিত্যাগ করে এক ধরণের বিপ্লব সাধন করতে হবে। পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রিক কাঠামোতে এই পরিবর্তন সাধন সম্ভব কি না সেটা বলা মুস্কিল তবে হয়ত এ জন্যে পাকিস্তানকে গোটা দক্ষিণ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে নিজেকে স্থাপন করতে হবে । কারণ তিক্ত হলেও সত্য যে পাকিস্তান যে ইসলামিক আদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল বলে প্রচার করা হয়, সেই সব আদর্শেরই বাস্তবায়ন চাইছে এই উগ্রপন্থিরা। অতএব পাকিস্তানের বৈরীপক্ষ এখন পাকিস্তান নিজেই। গত ষাট বছরে পাকিস্তান পিছিয়েছে অনেকখানি। মি জিন্নার ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পার্থক্য অনেক । এখন বোধ হয় প্রয়োজন একটি অসাম্প্রদায়িক আধুনিক পাকিস্তানের কিন্তু সেটা তো সোনার পাথরবাটিই কেবল ।



ইমেইল ঠিকানা : aauniruddho@gmail.com
এই লেখাটি সমকাল ‘এর ১৫ই নভেম্বর ২০০৭ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত।

No comments: