একজন অদ্বিতীয় বনাম একাত্তরের গল্প
-অনিরুদ্ধ আহমেদ
অদ্বিতীয়ের জন্ম আশির দশকের গোড়ার দিকে, কিংবা ধরুন সত্তরের দশকের শেষে, বাংলাদেশেরই কোনো এক বিভাগীয় শহরে। তখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার জোয়ার চলছে, খাল কাটার প্রবল উদ্যমের সঙ্গে তাল মিলিয়েই জামায়াতি কুমিররা একে একে প্রত্যাবর্তন করছে রাজনীতির সিংহদ্বার দিয়েই। বঙ্গবন্ধু তখন কেবলই শেখ মুজিবুর রহমান, প্রায় অনুচ্চারিত একটি নাম। তার অনুগামীদের একাংশ মিশে গেছে গড্ডালিকা প্রবাহে, অপরাংশ দ্বিধাবিভক্ত নিজেদের মধ্যে। রাজনীতির এ রকম এক পটভূমিতে অদ্বিতীয়ের জন্ম। হয়তো এখনকার এ সময়ে অদ্বিতীয় জন্মালে তার ডাকনাম হতো আধুনিক কোনো আরবি নাম, নিতান্ত সত্তর-আশির দশকের তরুণ বাবা-মা’রা বাংলা নাম রাখার শখ সংবরণ করতে পারেননি। মুসলমান হওয়া এবং বাঙালি হওয়ার এ পরিচিতি সংকট সত্ত্বেও অদ্বিতীয়ের ডাকনামটি নির্ভেজাল বাংলা রেখেছেন, কতটা বাঙালি পরিচিতি ধরে রাখার ইচ্ছায় এবং কতটা নিতান্ত হালের এবং বোধকরি কালেরও, ফ্যাশনের কারণে, সেটি বোঝা মুশকিল। কিন্তু অদ্বিতীয় নামটি নিঃসন্দেহে খুব যুতসই হয়েছে। এই প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই করা তরুণটি এখন এই উত্তর আমেরিকায় বাস করছে, বাবা-মার সঙ্গেই এবং বলাবাহুল্য, বাঙালিয়ানার হেরফের ঘটেনি তার জীবনে। সুযোগ পেলেই বাংলায় কথা বলতে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে অনেক বেশি। সদ্য কিশোরোত্তীর্ণ বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ডিভি লটারি পেয়ে যখন সে এসেছিল এ দেশে নব্বইয়ের দশকে, তার আগ পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমেই পড়েছে, বরং এখানে এসে ইংরেজি ব্যবহারে সংকোচ ছিল গোড়াতে; এখন রীতিমতো দক্ষ দ্বিভাষিক। পদার্থবিদ্যার চৌকস এ ছাত্রটির নাম যে বাবা-মা রেখেছিলেন অদ্বিতীয়, সেটা বোধকরি একেবারেই ভুল করেননি। অদ্বিতীয়ের জন্য গর্ব করার অনেক কিছুই আছে তার পরিবারের। এতকিছু সদর্থক বিষয় থাকা সত্ত্বেও, অদ্বিতীয় কিন্তু ইতিহাস সম্পর্কে বিমুখ, না বিজ্ঞানের ছাত্র বলে নয়, কারণ সাহিত্যে ওর আগ্রহ আছে, মাসুদ রানা পড়েছে রাত জেগে, এখানকার হিস্ট্রী চ্যানেলেও ছবি দেখে মাঝে মধ্যে। আমেরিকায় অভিবাসন গ্রহণ করায় দেশটির প্রতি তার ভালোবাসা নিখাদ কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের ব্যাপারে তার প্রবল অনীহা। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, এমন কী তাজউদ্দীন তাদের নাম শুনলে আপত্তি করে, বলে আবার ওই ইতিহাসের লেবু কচলিয়ে তেতো করার কী দরকার, তার চেয়ে বরং যেন গ্রামীণ ব্যাংকের শ্লোগানের মতোই বলে ওঠে এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ। এখানেই অদ্বিতীয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একাত্তরের কথা জানতে যারা চায় সেই একঝাঁক তরুণ-তরুণী থেকে। শিমুল কিংবা স্বাক্ষর, শাফাক কিংবা নাদিয়া যারা একাত্তরের কথা শোনার জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নিজেদের উদ্যোগে, একাত্তর-উত্তর প্রজন্মকে শোনাতে চায় একাত্তরের বস্তুনিষ্ঠ সেই ইতিহাস, তাদের থেকে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে আমাদের এই তরুণ অদ্বিতীয়। যে প্রজন্মকে ইদানীং সামাজিক ইতিহাসের দৃস্টিকোণ থেকে ‘জিয়া জেনারেশন’ বলা হয়। অদ্বিতীয় যেন সেই প্রজন্মেরই প্রতিনিধি, যারা ইতিহাসকে দেখে একটি বিশেষ দৃস্টিকোণ থেকে। এই তরুণরা যে পাকিস্তানপন্হী সেটা হয়তো বলা যাবে না। কারণ পাকিস্তান তাদের কাছে দূরের ইতিহাস, সম্পূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এক অস্তিত্ব কিন্তু ভারত বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সংশ্লিস্টতার ঐতিহাসিক সত্যকে যেহেতু তারা অস্বীকার করতে পারে না, সেহেতু সেই ইতিহাস তারা শুনতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ যেন তাদের অনুভূতিতে অনাবশ্যক কথা, অদ্বিতীয়রা মুক্তিযুদ্ধের কথায় কানে হাত দেয়, যেন কোনো এক অশ্লীল কথা বলছে কেউ। বিদেশে এ প্রজন্ম এসে যে পরিচিতি ও সংস্কৃতি রক্ষা করে, সেটি হলো ইসলামী সংস্কৃতি। সেজন্য অদ্বিতীয়রা সাঈদীর বক্তব্য শুনতে যায়, সাঈদীর ক্যাসেট বাজায় এবং সাঈদীর দল কিংবা তিনি নিজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন সে সত্যটি অদ্বিতীয়রা এড়িয়ে যায়, সজ্ঞানেই।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনতে অদ্বিতীয়দের আপত্তি কেন? এর কারণ অনুসল্পব্দান করার চেস্টা করেছি বারবার। এর একটি আপাত নির্দোষ কারণ হতে পারে এই যে, বাংলাদেশে রাজনীতির মেরুকরণের কারণে ইতিহাস নিয়ে যেসব বিতর্ক হয় সে সম্পর্কে এখানে অভিবাসী তরুণ-তরুণীরা হয়তো অনেকটাই বিভ্রান্ত এবং আমাদের এই তরুণ অদ্বিতীয়ের মতো ক্ষুব্ধও। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। কেননা এ ক্ষোভের কারণে কেউ নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে না। তাদের মতো বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ প্রজন্মের এটা বোঝা উচিত, সমসাময়িক রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদের কারণে আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অবমূল্যায়ন করি, আমাদের শিকড় অনুসন্ধানে বিমুখ হই, তা হলে অস্টিস্তই বিলুপ্ত হবে। তা হলে এর কারণ কী? অদ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, আওয়ামী বিরোধিতার রাজনীতির প্রভাব জিয়া জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এতটাই তীব্র যে, ওই দল কিংবা তার নেতৃত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের যে একটা অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, সেটি মানতে রাজি নয় তারা। অদ্বিতীয়দের অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায় আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর। কারণ, ইতিহাসের যেসব তিক্ত সত্য বেরিয়ে আসতে থাকে তখন সেটি ওই প্রজেন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়েছে। কারণ তাদের মগজ ধোলাই হয়েছে আগেই। তারা জেনেছে শেখ মুজিবের একদলীয় শাসনব্যবস্থার কথা, জেনেছে তার আমলে দুর্ভিক্ষের কথা কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধনের চেস্টা তাদের করতে দেওয়া হয়নি থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে সেই আশঙ্কায়। ইতিহাস নিয়ে এই লুকোচুরি খেলা চলেছে বাংলাদেশে গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তৃতীয় কারণ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের অবিচ্ছেদ্য সংশ্লেষণ। ওই জিয়া প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝেছে ভারত বিরোধিতা; সেখানে ভারতকে কীভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি সুহৃদ রাস্ট্র হিসেবে গ্রহণ করা যায়, সেই বিভ্রান্তিও তাদের মধ্যে কাজ করে। এসব কিছুর জন্য ওই প্রজন্মকে দায়ী করার চেয়ে বোধকরি যে পারিবারিক পরিবেশে তারা বড় হয়েছে সেই পারিবারিক পরিবেশকেই দায়ী করতে হয়। দায়ী করতে হয় পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকেও। ইতিহাসকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে দর্শন না করে আত্মীয়রা যখন চট করে বলে ফেলে যে, ‘ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’ তখন এ চর্বিতচর্বণ বাক্য উচ্চারণের পেছনে এক ধরনের পলায়নপরতা কাজ করে, ইতিহাসের তিক্ত সত্যের সামনে দাঁড়াতে তারা ভীত হয়ে পড়ে।
তিন. আমার এই প্রতীকী অদ্বিতীয়দের ইতিহাস বিমুখীনতার বিপক্ষে এগিয়ে এসেছে বাস্তবের একঝাঁক তরুণ-তরুণী। তারা সবাই একাত্তর-উত্তর প্রজন্ম, অদ্বিতীয়দেরই সমসাময়িক তারা। তারা বলছে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাদ-বিসম্বাদের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধকে জানতে হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার সঙ্গে যে কালিক ও স্থানিক ব্যবধান সৃস্টি হয়েছে, তার অসুবিধা সত্ত্বেও এ ব্যবধানই আমাদের ইতিহাস বুঝতে এক ধরনের বস্ট‘নিষ্ঠ শক্তি দেবে এবং আমরা নির্মোহভাবে সত্য অনুধাবনে সমর্থ হবো। একাত্তর যারা দেখেছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাঙালির সেই বাঁচার লড়াইয়ে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গেই কথোকথনের আয়োজন করছে একাত্তরের গল্প’র সীমা সাহা কিংবা তাসবির ইমাম (স্বাক্ষর) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া চৌকস তরুণ-তরুণী। তারা যেমন বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে, তেমনি সেই দেশের ইতিহাসকে তারা উপলব্ধি করতে চায় সবটুকু দেশপ্রেম দিয়ে। ইতিহাসের অনেক কিছুই যে এখনো আমাদের অগোচরে থেকে গেছে, সম্প্রতি সেই সত্য কথাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তানভীর মোকাম্মেল তাজউদ্দীন আহমেদের উপর তৈরী করা প্রামাণ্যচিত্রটির মধ্য দিয়ে। ভাবতে বিস্মিত বোধকরি যে, একাত্তরে আমরা কীসব নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব পেয়েছিলাম, যারা তাদের বর্তমান ত্যাগ করেছিলেন, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য! তেমনি এক স্বল্প উচ্চারিত নাম হচ্ছে, আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। শিমুল-স্বাক্ষররা এ সত্যগুলোকেই আমাদের সামনে নিয়ে আসতে চায়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসেছিল, সেই লজ্জা থেকে মুক্তি দিতে চায় আমাদের এই দেশমুখীন তরুণ প্রজন্ম। তারা কেউই উগ্র জাতীয়তাবাদী নয়, কিন্তু তারা ইতিহাসের সঙ্গে সেতু নির্মাণে আগ্রহী। তারা মনে করে না, ইতিহাস কেবল অতীত চারিতা; তাদের শিকড় সন্ধানে চেস্টার সঙ্গে শাখা বিস্তারের উদ্যমের কোনো বিরোধিতা নেই। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঔজ্জ্বল্যের স্বাক্ষর রাখতে চায়, কর্মজীবনে সাফল্য অর্জনে ব্রতী তারা কিন্তু স্বদেশকে, স্বদেশের ইতিহাসকে তুলে ধরতে চায় তারা সবার সামনে। সমান্তরালে তারা শ্রদ্ধা করে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষকে, বাঙালি সংস্কৃতিকেও। ইতিহাস অনুসন্ধানের এই চেস্টা বাঙালি তরুণ-তরুণীদের জন্য আরো প্রয়োজনীয় এ কারণে যে, রাজনৈতিক মতভেদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় থাকার কারণে অদূর অতীতে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে বারবার দেশে এবং বিদেশেও। এখন নিশ্চয়ই সময় এসেছে এ কথা বলার যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানুন, নেতৃত্বের অবদানের মূল্যায়ন করুন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের তিরস্কৃত করতে দ্বিধা করবেন না। একাত্তরের গল্প তো আসলে গল্প নয়, অশ্রু ও রক্তে মেশানো এক কঠিন বাস্তবতা। আর একাত্তর তো কেবল একাত্তরেই শুরু হয়নি, হয়েছে আরো দু’দশক আগে। আনন্দের কথা, বৃহত্তর ওয়াশিংটনভিত্তিক এই একাত্তরের গল্প সংগঠনটি এসব বিষয়ের দিকেই লক্ষ্য রেখেছে। তাদের এ উদ্যম যত বৃদ্ধি পাবে, এ উদ্যোগ যত বেগবান হবে অদ্বিতীয়রাও ততই বুঝতে পারবে স্বদেশের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা, নিজের অস্তিত্বের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা এক ধরনের।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments:
Post a Comment