Wednesday, February 21, 2007

মুখোশ

আজ সকালটা অন্যরকম। প্রতিদিনের মতো আজ সকালে বিছানায় গড়াগড়ি করলেন না প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী। হাল্কা শীতের মাঝেও উঠলেন। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন, আর মনে মনে কী যেন ভেবে গেলেন। আজ সরকারী ছুটি। য়্যূনিভার্সিটি বন্ধ, ক্লাসের ঝামেলা নেই। তবুও আজ ব্যস্ততার দিন। তাড়াহুড়া করে কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল সারলেন। কর্ণফ্লেক্স, স্যান্ডউইচ আর সয়ামিল্ক দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলেন। কুমিল¬ার খাদি পাঞ্জাবী-পায়জামা, শেরওয়ানী কলারের কটি জড়ালেন গায়ে। মাথায় ঘন জেল দিলেন। ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে হাজির। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আশরাফ চৌধুরী গাড়ীর পেছনের সীটে বসলেন। গাড়ী ছুটে চললো শহর পেরিয়ে আশরাফ চৌধুরীর নিজের এলাকায়। ...সবাই এমনভাবে ধরলো আর না বলা গেলো না। এছাড়াও এলাকার কৃতি সন্তান, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কিছুটা দায়বোধ তো আছেই। দু'ঘন্টার জার্ণি হলেও মাঝে মাঝে গ্রামে যেতে খুব ভালো লাগে তার। আজ ভালো লাগার পাশাপাশি মনে মনে একটা খসড়া করে চলেছেন আশরাফ চৌধুরী। হাল্কা কুয়াশা কেটে গাড়ী এগিয়ে চলেছে। মনের ভেতর কথকথার খসড়াটাও এগিয়ে চলেছে...।


দুই.
চারদিকে আজ সাজসাজ রব। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে সকালের রোদ কড়া হচ্ছে ক্রমাগত। স্কুলের ছেলেমেয়েরা ইউনিফরম পরে ছোটাছুটি করছে। কেউবা মাঠের মাঝখানে রোদ পোহাচ্ছে দলবেঁধে। মাইকে বেজে চলেছে দেশের গান, ভাষার গান। "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কী ভুলিতে পারি", "ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়, "আমি বাংলায় গান গাই"। বাংলা, বাঙালী, বাংলা ভাষা! স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত একটি নতুন সকাল। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রফেসর আশরাফ চৌধুরীর আগমনে গুঞ্জন-কোলাহল শেষে ফুলের মালায় অতিথিদের বরণ করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন আর জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্থানীয় গণ্যমান্যদের পর বক্তৃতা শুরু করেন প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী। এই সকালে শতশত কিশোর প্রাণের সমাবেশ দেখে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হন। নস্টালজিক হন। ৪০ বছর আগের একুশে ফেব্রুয়ারীর স্মৃতিচারণ করেন। তখনকার গ্রাম বাংলার নৈসর্গিক বিবরণ দেন, বাংলার গ্রামের মানুষদের সহজাত সারল্যের প্রশংসা করেন, নাগরিক জীবনের যন্ত্রণার কথা বলেন, সর্বস্তরে বাংলা চর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সাথে সাথে বাংলা সংস্কৃতির উপর বিদেশী ভাষার সম্ভাব্য আক্রমণের আশংকা করেন। দর্শকদের তালিতে মুখরিত হয় যাদবমোহন বিদ্যাপীঠের সবুজ প্রাঙ্গণ। মফস্বলের সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিষ্ঠার ব্যাপক প্রশংসা করে একুশের চেতনা লালন ও বিস্তারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা ক্লিক ক্লিক ছবি তোলে। মফস্বল সংবাদ পাতায় বিশেষ রিপোর্ট যাবে। অনুষ্ঠান শেষে সূধীজনের প্রশংসায় আপ্লুত হন প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার আগেই শহরে ফিরে আসলেন তিনি। সন্ধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে "আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একুশের চেতনা" টক শো-তে অংশ নিবেন তিনি।


তিন.
আড়ঙের ঝকঝকে পাঞ্জাবী, কাঁধে নকশীবাংলার শাল, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা পরে আলোচনা করছেন প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী। টিভি প্রোগ্রাম, তাই হাল্কা মেকআপও নিয়েছেন। সম্রাট আকবরের সময় থেকে শুরু করেছেন তিনি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পিরিয়ড, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ, সামরিক শাসন, গণ-অভ্যূত্থান; এভাবে সময় ভাগ করে কথা বলছেন তিনি। পর্যায়ক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থার পট পরিবর্তনের প্রসংগে গেলেন। ইংলিশ মিডিয়াম এডুকেশনের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করলেন। প্রাইভেট য়্যূনিভার্সিটিগুলোকে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূলধারার বাইরে বিভ্রান্ত ব্যবস্থা বলে বকাঝকা করলেন। শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলা, দেশীয় ঐতিহ্যে জীবন-যাপনের প্রয়াস, অপসংস্কৃতি, কালচারাল ইন্টারাপশান, কালচারাল ডাইভারশান, জেনারেশন গ্যাপ, স্যাটেলাইট প্রভাব, গ্লোবালাইজেশন আর পোস্ট-মর্ডানিজমের কঠিন কঠিন থিয়রী টেনে পাশ্চাত্য মোহে শেকল পরিয়ে অন্তজ: শেকড়ের টানে মূলধারায় ফিরে যাওয়ার শাশ্বত আহবান জানিয়ে প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী আলোচনা শেষ করেন।


চার.
রাতে বাসায় ফিরে প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী অনেকগুলো ফোন রিসিভ করলেন। চমৎকার বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। য়্যূনিভার্সিটির ডীন স্যারও ফোন করেছিলেন। ধন্যবাদ আর প্রশংসার জোয়ার বয়ে যায়। ডিনার শেষে বিছানায় গা হেলিয়ে বিজনেস উইক আর দ্য ইকনোমিস্ট ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলেন। পাশের রূমে স্কলাসটিকায় এ-লেভেল পড়ুয়া মেয়ে সিলভিয়া ফুল ভলিউমে জেনিফার লোপেজের ওয়েটিং ফর টু নাইট শুনছে আর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গুট্টুস গুট্টুস গল্প করছে। যুগল বন্ধন, একটেল জয় - কথা হয় যে কোন সময় নির্ভাবনায়, কাছে থাকুক প্রিয়জন। ড্রয়িং রূম থেকে মা আফসানা চৌধুরী মেয়েকে বকাঝকা করছেন। গানের শব্দে টিভি দেখতে অসুবিধা হচ্ছে তার। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি হিন্দি ডেইলী সোপ দেখে যাবেন। ও রেহনেওয়ালী মেহলোন কি, হারে কাঁচ কী ছুড়িয়া, সিন্দুর, কিট্টু সব জানতি হ্যায় কিংবা বলি সে তারে রিক্যাপ - কিছুই বাদ যাবে না। পরদিন উইমেন রাইটস ক্লাবে মিসেস আহমেদ আর মিসেস হকের সাথে একচোট হয়ে যাবে। তাই সিন্দুরের আজকের পর্বের ভেদিকা আর রূ˜্র রায়জাদার সংলাপগুলো খানিকটা মুখস্ত করে নেন। মা-মেয়ের কোলাহলে ম্যাগাজিনে মন দিতে পারছিলেন না প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী। আবার ফোন বাজে। স্টেটস থেকে ছেলে ফোন করেছে। প্রতি উইক-এন্ডে ছেলে ফোন করে কথা বলে। তার অ্যামেরিকান হোয়াইট বৌ শ্বশুরের ইংলিশ অ্যাকসেন্ট না বুঝায় কনভার্সেশনে ইন্টারেস্ট পায় না। তবুও ৭ বছরের নাতির সাথে কথা হয়

- হাই, গ্রান্ড ফা!- হ্যালো, হাউ আর য়্যূ?
- আই অ্যাম ফাইন, য়্যূ?
- মী টু। হাউ'জ য়্যূর ড্যাড অ্যান্ড মম?
- দে আর ওকে, বাট কোয়ারেল সামটাইম। প্লিজ গ্রান্ড ফা, টেল ড্যাডি টু টেক মী বাংলাদেশ।
- ওহ ডিয়ার ডোন্ট সে দিস। ইটস অ্যা ভেরী ডার্টি কান্টি ্র , নাথিং টু সি এরাউন্ড।
- হোয়াই?- ইট'স অ্যা পুওর ক্রাউডি ল্যান্ড। ফুল অব আনকালচার্ড পিপল।
- সো হোয়াট? য়্যূ আর গুড!
- নো! ইফ আই হ্যাড অপশন, আই উড হ্যাভ লেফট দিস ল্যান্ড।

সফল মানুষ প্রফেসর আশরাফ চৌধুরীর আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ!

1 comment:

Aman said...

চমৎকার.. এই উপলব্ধিটা প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ,আমরা যারা প্রকাশ করতে পারি না তাদের পক্ষ থেকে।

হাজার দুয়ারী সাইট টা দেখছি। আরেকটা চমৎকার সৃষ্টি। নাহ্,
অফিসে কাজ করাটা খুব কষ্টকর করে ফেলেবেন দেখছি!!