Thursday, July 19, 2007

শেখ হাসিনার গ্রেফতার ও জামিন না দেওয়া :

শেখ হাসিনার গ্রেফতার ও জামিন না দেওয়া :
এটিএম মোরশেদ আলম
১৯ জুলাই ২০০৭

সমকাল পত্রিকার সৌজন্যে।
আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘বিলম্ব ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করে’ অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে বিলম্ব করলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে একটা নির্দিস্ট সময় পরে মামলা করার অধিকারই থাকে না। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে যদিও কোনো সময়সীমা নির্দিস্ট করা হয়নি কিন্তু মামলার বিলম্ব আসামিকে সুবিধা প্রদান করবে। তাছাড়া ফৌজদারি আইন বিজ্ঞানের মূল কথাই হলো ‘অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ।’ সুপ্রতিষ্ঠিত আরেকটি নীতি হলো, ‘আইনের আশ্রয় নিতে হলে পরিস্কার হাতে আসতে হবে।’ অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তাহলে তাকেও পরিস্কার থাকতে হবে। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি কারো বিরুদ্ধে আঘাত করার অভিযোগ আনে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, সে কোনো আঘাত করেনি। অর্থাৎ বিষয়টি মারামারির পর্যায়ে যায়নি। ঘুষ গ্রহণ করা যেমন অপরাধ, ঘুষ প্রদান করা তেমনি অপরাধে সহায়তা করা। অনেক সময় অপরাধে সহায়তার শাস্ত মূল অপরাধের সমান।

শেখ হাসিনাকে যে মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, তা একটি চাঁদাবাজির মামলা। প্রায় আট বছর আগের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে ১৩ জুন ২০০৭। শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন মামলা করা না গেলেও গত ৬ বছরের যে কোনো সময় মামলাটি দায়ের করা যেত। কিন্তু এরূপ করা হয়নি। এই বিলম্বই মামলার প্রাইমা ফেসি কেইসকে দুর্বল করে দিয়েছে অর্থাৎ প্রাথমিকভাবেই মামলাটি অভিযোগকারীর বিপক্ষে চলে গেছে। তাছাড়া চাঁদা প্রদান করে অভিযোগকারীও অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তিনিও আইনের চোখে অপরাধী।


শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে দন্ডবিধি আইনের ৩৮৫ ধারায়। ৩৮৫ ধারায় বলা হয়েছে, বলপূর্বক সম্পত্তি আদায় করার উদ্দেশ্যে যদি কেউ আঘাতের ভয় দেখায় বা দেখানোর চেস্টা করে তাহলে সে ১৪ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদন্ডে , অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে। এই ধারা অনুসারে কেউ অভিযুক্ত হলে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। তবে অপরাধটি জামিনযোগ্য এবং জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ঐব ংযধষষ নব ৎবষবধংবফ ড়হ নধরষ.’ আইনে ‘ংযধষষ’ শ্বন্ধটি যখন ব্যবহার করা হয় তখন তা অবশ্য পালনীয় হয়ে যায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার এবং আদালত জামিন দিতে অনেকটাই বাধ্য।

উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যদি আসামির মৃত্যু বা যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে আদালত নিম্নের ৫টি বিষয় বিবেচনাপূর্বক আসামিকে জামিন প্রদান করতে পারেন।

১. আসামির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি-না। যদি তেমন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকে তাহলে জামিন মঞ্জুর করা হবে।
২. আসামি এতই দুর্দান্ত এবং প্রবল যে, জামিনে মুক্তি দিলে তিনি সাক্ষীদের প্রভাবিত করবেন কিংবা আলামত নস্ট করে দেবেন। ৩. আসামি এমন একটি অপরাধ করেছে, যার জঘন্যতা জনগণের ধিক্কার কুড়ায়, তাহলে জামিন দেওয়া হয় না।
৪. যদি আসামিকে বারবার একই অপরাধে লিপ্ত হতে দেখা যায়, তাহলে তাকে জামিন দেওয়া হয় না।
৫. আসামির অবস্থা এতই করুণ যে, তাকে জামিন দেওয়া না হলে জেলে থেকে মামলার খরচ জোগাড় করতে পারবে না, তাহলে জামিন দেওয়া হয়।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এটা জানা গেছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যিনি মামলা দায়ের করেছেন তিনি কতগুলো চেকের মাধ্যমে চাঁদা প্রদান করেছিলেন। যে চেকগুলোর মাধ্যমে চাঁদা দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর গ্রাহকের নামের অংশে লেখা ছিল ংবষভ অর্থাৎ যে কেউ ওই চেক ভাঙাতে পারবে। ওই চেকগুলো শেখ হাসিনা ভাঙিয়েছেন এটা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। এ কথা তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেছেন বলে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যথেস্ট প্রমাণ নেই। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার জামিন পাওয়ার সুযোগ ছিল।

এখন আসা যাক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কথায়, শেখ হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যেহেতু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে তাই তাকে গ্রেফতার না করে উপায় ছিল না। কারণ, চার্জশিট দিতে হলে আসামিকে হয় পলাতক কিংবা গ্রেফতার দেখাতে হবে। শেখ হাসিনাকে যেহেতু পলাতক দেখানো সম্ভব নয় তাই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ কথাকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় প্রথমত, মামলায় চার্জশিট দেওয়া হবে নাকি ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হবে, তা তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ কেবল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরই জানার কথা। প্রয়োজনে স্বরাস্ট্র উপদেস্টার বিষয়টি জানতে পারেন; কিন্তু কোনো মতেই আইন উপদেস্টার জানার কথা নয়। তাহলে কি বিষয়টা উপদেস্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে এবং চার্জশিট দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয়ত, কোনো একজন আসামিকে গ্রেফতার করাতে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু গ্রেফতার করার পর জামিন দিতেও কোনো বাধা নেই। সেক্ষেত্রে চার্জশিটে লেখা থাকবে আসামি জামিনে। দেশের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী হিসেবে জনাব মইনুল এ ধরনের কথা বললে সত্যই অবাক লাগে।

পূর্বের আলোচনার সুর ধরে একটি কথা আবার বলা প্রয়োজন, বিচারের শুরুতে যেহেতু প্রত্যেক আসামিকেই নির্দোষ ধরা হয়, তাই তার সম্মান, খেতাব, পদমর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি সব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। এজন্যই ডিভিশন জেলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে আইনে। শেখ হাসিনা যেহেতু বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের প্রধান ছিলেন, সুতরাং তার মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সরাসরি গ্রেফতার না করে সর্বপ্রথম একটা সমন জারি করা বেশি যুক্তিসঙ্গত ছিল; যেমনটি করা হয়েছে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু তেমনটি না করে, এমনকি আদালতের কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এজন্য এমন নাটকীয়তা করা হয়েছে, যা সত্যিই আশ্চর্যজনক।

দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, ঘুষখোরদের শাস্তি হোক এটা সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই চাই। কিন্তু এই শাস্টি দানের প্রক্রিয়াটা হতে হবে আইনি ও যথাযথ। অর্থাৎ আইনে যে পদ্ধতিতে বিচারের কথা বলা হয়েছে সে পদ্ধতিতে বিচার করা বাঞ্ছনীয়।

যদি তা না করা হয় তাহলে মামলাগুলো যখন উচ্চ আদালতে আপিলের জন্য যাবে, তখন সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি এ অজুহাতেই সব অভিযুক্ত ব্যক্তির ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ফলে বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান তা পুরোটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। আর এই সুযোগে আসল দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ ছাড়া পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক : আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী

No comments: