A Group Blog to talk about Bangladesh Politics, Society, Media and Human Rights
Thursday, September 20, 2007
যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি
যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি
অভিজিৎ রায়
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭।
Source: Mukto-Mona
‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশী, ধর্মের আগাছা বেশী’ লালসালু লিখতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ আবহমান বাংলার যে ছবি এঁকেছিলেন, তারই সার্থক রূপায়ন যেন দেখলাম আজ বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা খুলে। প্রথম আলোর একটা স্পেশাল রম্য সাময়িকী বেরোয় – আলপিন নামে। সেখানে একটা কার্টুন ছাপা হয়েছে। কার্টুনটা ছিল একেবারেই নির্দোষ ধরণের কৌতুকের উপর ভিত্তি করে। এ ধরণের অনেক কৌতুক আমরা ছেলেবালায় বন্ধু বান্ধবদের সাথে ইয়ার্কি করার ছলে কত্ত করেছি – তাও প্রাইমারি স্কুল জীবনে। আলপিনে প্রকাশিত কার্টুনটা এরকম :
একজন পরহেজগার ভদ্রলোক একটি ছেলের সাথে রাস্তায় কথা বলছেন। ছেলেটি টোকাই ধরনের,তার হাতে একটা বিড়াল। লোকটি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করছে ;
এই ছেলে তোমার নাম কী?
-আমার নাম বাবু
নাম বলার আগে মোহাম্মদ বলতে হয়।
তোমার বাবার নাম কী?
-মোহাম্মদ আবু
তা তোমার কোলে এটা কী?
- মোহাম্মদ বিড়াল
এই সামান্য একটা কার্টুন দেশে লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে দিল। ঐ যে বলেছিলাম যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশী, ধর্মের আগাছা বেশী থাকে সে দেশে ফালতু বিষয় নিয়ে লঙ্কা কান্ড বাঁধতে কাঁচামালের কখনোই কোন অভাব হয় না। দেশে দ্রব্যমূল্য বাড়তে বাড়তে গগনচুম্বী, সাধারণ মানুষদের আবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ‘ত্রাহি ত্রাহি’, যেখানে পর পর দু’বারের বন্যার ছোবলে জন জীবন বিপর্যস্ত, প্রতিদিনই আইন শৃংখলার মারাত্মক অবনতি ঘটে চলেছে, শিক্ষকদের রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে সব কিছু ফেলে কোন এক অখ্যাত ‘মোহাম্মদ বিড়াল’ জাতীয় কার্টুন নিয়ে মাতামাতি করে লঙ্কা কান্ড বাঁধানো আমাদের পক্ষেই সম্ভব।
লঙ্কা কান্ডের জের হিসাবে পুলিশ কার্টুনিস্ট আরিফকে গ্রেপ্তার করেছে। আর ‘নিরপেক্ষ’ এবং আওয়ামী-বি এন পির দুর্ণীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার মতিউর রহমান (দুর্মূখেরা বলেন, যার সাথে আসলে জামাতী মহাপুরোহিতের পার্থক্য কেবল এক শব্দের) তার নিরপেক্ষতা জাহির করতে আলপিন ম্যাগাজিনের সম্পাদককে পত্রিকা থেকে বের করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার পত্রিকার ওই পোষা ‘মোহাম্মদ বিড়াল’র মতই মিউ মিউ করতে করতে হাত কচলাতে কচলাতে প্রথম পাতায় একটা “এপোলজি লেটার” ছাপিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত করায় তারা মানে তার পত্রিকা যার পর নাই অনুতপ্ত। হায়রে ধর্ম, হায়রে অনুভূতি। বিড়াল তপস্বী একেই বলে। কয়েকটা চুনোপুটি মোল্লাদের চ্যাচামেচিতেই মহাপরাক্রমশালী ব্যাঘ্রসম ‘নিরপেক্ষ মতি’ মুষিকে পরিণত হয়ে গর্তে সেঁদিয়ে গেলেন। কোথায় গেল তার পরিবারতন্ত্র আর দুর্ণীতির বিরুদ্ধে চলমান জিহাদ, কোথায় গেল শার্দুলের হুঙ্কার। কোথায় তিনি বুক চিতিয়ে নিজস্ব সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট আর সাময়ীকির সম্পাদকের পাশে এসে দাঁড়াবেন, কোথায় স্পষ্ট করে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে নির্দোষ কৌতুকের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়ে সম্পাদকীয় লিখবেন, তা না! এতদিনের বিপদ-আপদের সহোযোগিদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে নিজে ভাল –মানুষ সেজে গেলেন। এমনভাবে বিবিসিতে নিজের শ্যালককে দিয়ে সাক্ষাতকার দিলেন যেন পুরো দোষ ওই নচ্ছার সম্পাদক আর তরুণ কার্টুনিস্টের। জলপাই প্রীতি আর দালালি যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তার মেরুদন্ড সোজা থাকবে কি করে।
আর অন্যদিকে আমাদের ব্যারিস্টার মাইনুল সাহেবের নিজস্ব ঘরণার পত্রিকা ইত্তেফাক শুরু করল আরেক তেলেসমাতি। তথ্য বিকৃত করে ওই বাচ্চা ছেলেটার কোলের বেড়ালটার দাঁড়ি পর্যন্ত গজিয়ে ছেড়ে দিলেন। ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লেখা হল :
প্রসঙ্গতঃ প্রথম আলোর সাময়িকী ‘আলপিন’-এ একটি কার্টুনে একটি হুলো বিড়ালের মুখে দাড়ি লাগিয়ে তার নাম দেয়া হয় ‘মোহাম্মদ বিড়াল’। এছাড়া ‘সংযম’ নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ব্যঙ্গচিত্র।“
গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকে। পাঠকদের জন্য উপরে আলপিনের কার্টুনটি অবিকল তুলে ধরা হল। ইত্তেফাকের সম্পাদক মহাশয় কোথায় বিড়ালের মুখে দাড়ি খুঁজে পেলেন আর কোথায়-ই বা সংযম নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র পেলেন তা তিনিই ভাল জানেন। পাঠকদের জন্য কার্টুন টি নীচে দেওয়া হল :
ধর্মব্যাবসায়ীদের ওই এক স্বভাব। ধর্মের মাথায় মধু ঢেলে প্রমুহূর্তেই প্রয়োজনে ধর্মকে সাক্ষী রেখে লুচ্চামী, লোফারি আর মিথ্যা কথা বলতেও বাঁধে না। ধর্মকে মাথায় তুলে মানুষ মারতে, দাংগা বাধাতেও কখনো তাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় না। অথচ এই ধর্মই নাকি শিক্ষা দেয় নীতি, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের। ধর্ম ছারা নাকি সমাজ উচ্ছন্নে যায়। অথচ আমি ত দেখি বাস্তবতা পুরো উলটো। এ জন্যই কি গনিতবিদ ব্লেইজ প্যাস্কাল (১৬২৩-১৬৬২) বহু আগেই বয়ান করেছিলেন – “Men never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction.” একাত্তরের গোলাম আজম নিজামী থেকে শুরু করে হাল আমলের লাদেন, বাংলাভাই, মইনুল, বায়তুল মোকারমের খতিব সহ সবাই বারে বারে প্রমাণ করছেন এই উক্তির সার্থকতা।
গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের দ্বিতীয় ধাপে আসে সবকিছুতে ষড়যন্ত্র-এর গন্ধ আবিস্কার। খবরে প্রকাশ, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিনে হযরত মোহাম্মদ-কে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করার ঘটনাটিকে দেশের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ও গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গতকাল তার দফতরে দেশের বিশিষ্ট আলেমদের উপস্থিতিতে ও বৈঠক শেষে উপদেষ্টা আরও বলেন, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার ন্যায় দেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ। হাটু-বাহিনী ব্যাকড সরকারের উপদেষ্টা থেকে এর চেয়ে বেশী আর কি আসা করা যায়? উর্দি-ওয়ালাদের কাজ-ই হচ্ছে সবকিছুতে ষড়যন্ত্রের আলামত আবিস্কার করা। দশ পয়সা রেশনের চাল খাইয়ে আর ভর রোদ্দুরে প্যারেড করিয়ে ওই একটা জিনিস-ই খুব ভাল মত মাথায় গঁজে দেওয়া হয়। সব জায়গায় শুধু যড়যন্ত্র আর যড়যন্ত্র। আকাশে যড়যন্ত্র, বাতাসে যড়যন্ত্র। খালে বিলে সর্বত্র কেবল যড়যন্ত্র। সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হলে তার পেছনে থাকে ‘বিশেষ মহলের’ যড়যন্ত্র, কোথাও গণবিক্ষোভ হলে তার পিছনে যড়যন্ত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন হলে তার পেছনে থাকে যড়যন্ত্র, উস্কানী, নইলে নীল নকশা। নির্দোষ কার্টুন-ই বা এই তত্ত্ব থেকে বাদ যাবে কেন?
ধর্মানূভূতিতে আঘাত, উস্কানি, আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে আলপিন আর প্রথম আলোর উপর। নিরপেক্ষ চোখে বিচার করে দেখুন – ওই তিনটি অভিযোগ-ই আসলে আনা উচিৎ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আর তার পোষ্য ইত্তেফাকের প্রতি। অথ্য বিকৃত করে উস্কানি, মানুষের সত্যিকার অনুভূতিতে আঘাত আর মোল্লাতন্ত্রের সাথে মিলে দেশটাকে বারোটা বাজানোর “প্রাসাদ ষড়যন্ত্র”– কোনটা থেকেই ত চোখ ফেরাবার জো নেই। সেই সাথে, প্রথম আলোকে দাবিয়ে (পারলে এই সুযোগে নিষিদ্ধ করে) নিজের প্রায় মিউজিয়ামে পাঠানো ইত্তেফাককে সচল করার লোভাতুর প্রচেষ্টা আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে কই? সে জন্যই মাওলানা মহিউদ্দিন খান যখন বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মনে আঘাত করা হয়েছে। এর জন্য প্রথম আলোর ঘোষণাপত্র বাতিল ও প্রকাশক-সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি“ তখন ব্যারিস্টার মইনুল বিচলিত হন না, বরং মোল্লাতন্ত্রের কথায় সায় দিয়ে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার ন্যায় দেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ” আবিস্কার করে পুলকিত হন। হয়ত তক্কে তক্কে ছিলেন এই সুযোগে প্রথম আলোকে নিষিদ্ধ করা যায় কিনা। গেলেই তো ষোল কলা পূর্ণ। কিন্তু আমাদের মতি মামাও তো কম শেয়ানা না। হাত-পা কচলিয়ে বক্স নিউজ করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। আর মইনুল-মতির যুদ্ধে উলু-খাগরার মতই প্রাণ গেল (পড়ুন রিমান্ডে ছ্যাচা খেল) বিশ বছর বয়সী এক কার্টুনিস্টের। বড়-ই পরিতাপের বিষয়- ছেলেটির ক্যারিয়ারের প্রথম জীবনটাই এভাবে খোঁড়া করে দেওয়া হল।
আরেকটা জিনিসও প্রমাণিত হল। গুটি কয় বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি হলেও মোল্লাতন্ত্র হারিয়ে যায় নি। এরা বার বার-ই ফিরে আসে কখনো মওলানা মহিউদ্দিন কখনো বা খতিব ওবায়দুল্লাহর বেশে। আজ মেনে নিতেই হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোল্লাতন্ত্র অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যে মোল্লাতন্ত্রকে “মিডিয়ার সৃষ্টি” বানিয়ে খালেদা-নিজামী চক্র দুধ-কলা দিয়ে একদা বড় করেছিলেন, হাসিনা-জলিল সেটাকে বিস্তৃত করেছেন খেলাফত মজলিশের মত উগ্রমোল্লাদের সাথে চুক্তি করে, ঠিক একই ধারায় এখন মইনুল সাহেব মোল্লা মহিউদ্দিন বা ওবায়দুল্লাহর মত কতগুলো অশিক্ষিত মুর্খ ধর্মান্ধদের সাথে (পড়ুন বিশিষ্ট আলেম সম্প্রদায়) মিলে মিশে সলাপরামর্শ করে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে পথ খুঁজছেন। বলা নিষ্প্রয়োজন, যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, যে দেশে আগাছাদের দিয়ে দেশোদ্ধার করতে হয় সে দেশের ভবিষ্যত মোটেই উজ্জ্বল নয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment