(Renowned Writer and Columnist Bodruddin Umar writes a news analysis in Bangladesh Daily on August 20th incident in Dhaka University. He condemns the remand orders against the university professors and explores the root causes of huge public uproar against military government in Bangladesh)
নাকের বদলা নরুণ পেলাম -বদরুদ্দীন উমর Source: সমকাল আগস্ট ২৮, ২০০৭
২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে শুরু হয়ে ২১ ও ২২ আগস্ট সারাদেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং জনগণের মধ্যেও যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল সরকারিভাবে তার মোকাবেলা করা হয়েছে। সরকার এখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
এই পদক্ষেপের মধ্যে নতুন কিছু নেই। চিরাচরিতভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ঘটনা স¤ক্সর্কে যেসব কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে, তা-ই এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার উদগ্র চেস্টা যত আছে তার তিলার্ধও নেই এর প্রকৃত কারণ অনুসল্পব্দানের। এ অবস্থা কোনো ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতাকেই আগের থেকে বেশি সংহত করে না। উপরন্তু তাকে গভীরতর সংকটের মধ্যে নিক্ষেপের শর্তই বাস্তব ক্ষেত্রে তৈরি করে।
একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট অনুযায়ী (ঘবি অমব ২৬.৮.০৭) বিগত ক’দিনে সরকার উপরের ঘটনার সঙ্গে স¤ক্সর্কের অভিযোগে ৮৭ হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। অন্য একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট (আমার দেশ ২৬-৮-০৭) অনুযায়ী মামলার আসামি করা হয়েছে এক লাখ লোককে (সংবাদ মাধ্যমে বর্ণিত পুলিশের ভাষ্য হলো, অভিযুক্তদের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না বি.স)। এভাবে মামলা দায়ের যে উল্টো উৎপাদক হতে বাধ্য তার সিদ্ধ প্রমাণ থাকা, যে হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কথা বলা হয়েছে তাদের কারো নামের উল্লেখ এগুলোতে নেই। বেনামী হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা দায়েরের কোনো আইনগত ভিত্তি যে নেই, তা বলাই বাহুল্য। এভাবে মামলা দায়ের সাইক্লোনের পর বাতাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই এক তামাশার ব্যাপার। কোনো সরকার কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন তামাশা করতে পারে এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা নেই। সরকারের অবস্থা এবং দেশের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কিছুদিনের মধ্যেই সরকার সারাদেশের জনগণের (মুস্টিমেয় ব্যতিত্রক্রম ছাড়া) বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে ছাত্র বিক্ষোভ পরিস্থিতি সৃস্টির ইল্পব্দনদাতা ও চক্রান্তকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ‘অপরাধ’ তারা ছাত্র বিক্ষোভের সময় ছাত্রদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখা দরকার, ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ অকারণে সৃস্টি হয়নি। এর সূত্রপাত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে, যেখানে এই শিক্ষকদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। পরে ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা নিজেরা যখন বিক্ষোভ শুরু করে তখন কিছুসংখ্যক শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিক্ষোভের ন্যায্যতা উপলব্ধি করে তাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছাত্রদের পাশে তাদের শিক্ষকরা যদি না দাঁড়ান তাহলে শিক্ষক হিসেবে কে তাদের শ্রদ্ধা করবে? তাছাড়া এ ধরনের বিক্ষোভ আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের ঐক্য এ দেশে কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এই সংঘর্ষের দৃস্টান্ত পাওয়া যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত অসংখ্য আন্দোলনের মধ্যে। এই সম্পর্কে এ দেশে ঐতিহ্যগতভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শক্তির জোগান দিয়েছে। সরকার এখন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষককে আটক করেছে। কিন্তু এটা খুব জোর দিয়েই বলা চলে, অল্প কিছু ব্যতিত্রক্রম ছাড়া সব শিক্ষকেরই সমর্থন ছিল এবং আছে ছাত্রদের পক্ষে।
শিক্ষকদের গ্রেফতারের সঙ্গে সম্পর্কিত যে নতুন ব্যাপার এখানে দেখা গেল তা হচ্ছে, তাদের সরাসরি জেলে না নিয়ে ৩৬ ঘণ্টা সম্পূর্ণভাবে পর্দার আড়ালে রাখা এবং তারপর তাদের আদালতে উপস্থিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪ দিন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দশদিনের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া। এ ধরনের ব্যাপার ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে ১৯৬৯-’৭১-এর আন্দোলন পর্যন্ত কোনো সময়েই দেখা যায়নি, এর চিন্তা পর্যন্ত করা যায়নি। কিন্তু পাকিস্থানিদের শাসন আমলেও যা দেখা যায়নি, সেটাই এখন দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে। এসব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা এখন কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পুলিশের রিমান্ডে ত্রিমিন্যাল চার্জে গ্রেফতারকৃত লোকদেরই নেওয়া হয়, যদিও এভাবে পুলিশ রিমান্ডে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নেওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাকিস্থান আমলে, এমনকি সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকেও এভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রিমান্ডে নেওয়ার রীতি ছিল না, থাকলেও তার দৃস্টান্ত বিরল ছিল। কিন্তু এখন যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া পরিণত হয়েছে এক অতি সাধারণ রীতিতে। একজনকে গ্রেফতার করেই তাকে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয় এবং আদালত প্রায় সব ক্ষেত্রেই রিমান্ডের মেয়াদ কিছুটা কমিয়ে আবেদন মঞ্জুর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও পুলিশের রিমান্ডের আবেদন যে আদালত মঞ্জুর করবেন এটাও এক অভাবনীয় ব্যাপার। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আরো উল্কেèখ করা দরকার যে, ঢাকা ও রাজশাহী উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই পুলিশ দশদিন করে রিমান্ডের আবেদন করে যা সাধারণত বড় ত্রিক্রমিনালদের ক্ষেত্রেও করা হয় না। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে মাননীয় আদালত ঢাকার শিক্ষকদের জন্য ৪ দিনের এবং রাজশাহীর শিক্ষকদের জন্য পুরো দশদিনের রিমান্ডই মঞ্জুর করেছেন। এসব দেখেশুনে, যাদের অন্য কিছু করার নেই তাদের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ধরনী দ্বিধা হও’ বলা ছাড়া আর উপায় কী?
২০ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনাবলির চক্রান্তকারী এবং উস্কানিদাতা বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু আছে এ রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার যদি তাদের খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যায় তাহলে সেটা হবে অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার মতোই ব্যাপার। এর জন্য তারা যতই লোকজন গ্রেফতার করুন, তাতে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা নেই, যা নেই তা খোঁজার চেস্টা পন্ডশ্রম ছাড়া আর কী?
দেশের পরিস্থিতির যারা খোঁজখবর রাখেন এবং সত্যনিষ্ঠভাবে যারা ঘটনার বিচার করতে চান, তাদের সবারই একবাক্য হলো উপরোক্ত ওই তিনদিন যা ঘটেছে তা ষোলআনা স্বতঃম্ফূর্ত, তার মধ্যে উস্কানি, চক্রান্ত ইত্যাদির নামগন্ধ নেই। এক্ষেত্রে সত্যিকার উস্কানির সন্থান যদি করতে হয় তাহলে সেটা সত্যনিষ্ঠভাবে করা দরকার ২০ আগস্ট খেলার মাঠের ঘটনার মধ্যে। উস্কানির কথাই যদি এক্ষেত্রে বলা হয়, তাহলে ওই ঘটনার রিপোর্ট সামান্য পর্যালোচনা করলেই তাৎক্ষণিক উস্কানিদাতার পরিচয় সহজেই পাওয়া যাবে।
কোনো কিছু সমর্থন করা এবং সে ব্যাপারে উস্কানি দেওয়া এক কথা নয়। কাজেই যে শিক্ষকদের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের থেকে উস্কানি অথবা চক্রান্তের কোনো তথ্য পাওয়া যাবে এটা মনে করার কারণ নেই। রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আদর করে না এটা জানা কথা। এই শিক্ষকদেরও আদর করা হবে না।
গ্রেফতারকৃত শিক্ষকরা কোনো দুর্নীতিবাজ নন। তারা রাজনৈতিক বন্দি। কাজেই তারা সর্বতোভাবে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। রিমান্ডে নিয়ে তাদের এই মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। এরপর রিমান্ড শেষে তাদের জেলখানায় যদি রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা না দিয়ে সাধারণ আসামির সঙ্গে রাখা হয় তাহলে তার দ্বারা গোটা জাতির মর্যাদাই ভূলুণ্ঠিত হবে। কাজেই এসব না করে পাঁচজন গ্রেফতারকৃত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া দরকার। সারাদেশের জনগণও যে এই দাবির পক্ষে এটা সহজেই বোঝা যায় এবং সংবাদপত্রে বিভিল্পু মহলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও তার প্রমাণ মেলে।
একটি দেশে জনগণ যখন কোনো সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ ও মারমুখো হয় তখন তার কারণ অবশ্যই থাকে। ‘উস্কানি তত্ত্ব’ অনুযায়ী এই কারণকে উস্কানি হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে।
বাংলাদেশে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের চরম দুর্নীতি ও জনবিরোধী নানা কাজের মাধ্যমে দেশে এক সংকটজনক পরিস্থিতির সৃস্টি করেছিল। সেই সংকট সমাধানের চেস্টার মধ্যে না গিয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ এমনভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও শত্র“ বিএনপির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছিল যাতে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে ভয়াবহ হয়েছিল। সেই ভয়াবহ অবস্থায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এ কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এদের প্রতি এক ধরনের সমর্থন জনগণের মধ্যে ছিল, যদিও এ ধরনের সরকারের স্বাভাবিক গতি কোন দিকে এ বিষয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহের অভাব ছিল না।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সাত মাস পার হলেও বাংলাদেশ যে সাধারণ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল সে সংকট তার কাটেনি, উপরন্তু আরো গভীর হয়েছে। জনগণের জীবন আগের থেকেও এখন অনেক বেশি দুর্বিষহ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য দ্রুত ও ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া; কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকারে পরিণত হওয়া; সরকারি ও বেসরকারি কারখানার লাখ লাখ শ্রমিকের মাসের পর মাস মজুরি বকেয়া থাকা ও তা পরিশোধ না করে মিল-কারখানা বল্পব্দ করা; কৃষিঋণের সুদ বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণের মহৃল্য বৃদ্ধি, কৃষককে কোনো ভর্তুকি না দেওয়া, কৃষক ফসলের ন্যায্যমহৃল্য না পাওয়া, গ্রামাঞ্চলে কাজ না থাকা; শহরে ছিল্পুমহৃল মানুষের বস্তি ও কাজের জায়গায় তাদের ওপর আক্রমণ, হকার উচ্ছেদ; ছাত্রদের বেতন-ফি বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য এবং জরুরি অবস্থার নামে জনগণের সব ধরনের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করার দ্বারা এমন অবস্থা সারাদেশে সৃস্টি হয়েছে যার মধ্যেই জনগণকে বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো ‘উস্কানি’র উপাদান যথেস্ট আছে। কাজেই এসব দিকের মধ্যেই বিস্ফোরণের আকারে বিক্ষোভের কারণ সন্ধান করতে হবে। যেখানে এ দেশের ইতিহাসে ব্যাপকতম গণবিক্ষোভের জন্য এক লাখ বেনামী লোকের বিরুদ্ধে পুলিশকে মামলা দায়ের করতে হয় সেখানে ‘উস্কানি’র আসল উৎস কোথায় এটা বোঝার কি কোনো অসুবিধা আছে?
নাকের বদলা নরুণ পেলাম -বদরুদ্দীন উমর Source: সমকাল আগস্ট ২৮, ২০০৭
২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে শুরু হয়ে ২১ ও ২২ আগস্ট সারাদেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং জনগণের মধ্যেও যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল সরকারিভাবে তার মোকাবেলা করা হয়েছে। সরকার এখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
এই পদক্ষেপের মধ্যে নতুন কিছু নেই। চিরাচরিতভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে এবং এ ধরনের ঘটনা স¤ক্সর্কে যেসব কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে, তা-ই এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার উদগ্র চেস্টা যত আছে তার তিলার্ধও নেই এর প্রকৃত কারণ অনুসল্পব্দানের। এ অবস্থা কোনো ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতাকেই আগের থেকে বেশি সংহত করে না। উপরন্তু তাকে গভীরতর সংকটের মধ্যে নিক্ষেপের শর্তই বাস্তব ক্ষেত্রে তৈরি করে।
একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট অনুযায়ী (ঘবি অমব ২৬.৮.০৭) বিগত ক’দিনে সরকার উপরের ঘটনার সঙ্গে স¤ক্সর্কের অভিযোগে ৮৭ হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। অন্য একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট (আমার দেশ ২৬-৮-০৭) অনুযায়ী মামলার আসামি করা হয়েছে এক লাখ লোককে (সংবাদ মাধ্যমে বর্ণিত পুলিশের ভাষ্য হলো, অভিযুক্তদের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না বি.স)। এভাবে মামলা দায়ের যে উল্টো উৎপাদক হতে বাধ্য তার সিদ্ধ প্রমাণ থাকা, যে হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কথা বলা হয়েছে তাদের কারো নামের উল্লেখ এগুলোতে নেই। বেনামী হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা দায়েরের কোনো আইনগত ভিত্তি যে নেই, তা বলাই বাহুল্য। এভাবে মামলা দায়ের সাইক্লোনের পর বাতাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই এক তামাশার ব্যাপার। কোনো সরকার কীভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন তামাশা করতে পারে এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা নেই। সরকারের অবস্থা এবং দেশের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কিছুদিনের মধ্যেই সরকার সারাদেশের জনগণের (মুস্টিমেয় ব্যতিত্রক্রম ছাড়া) বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে ছাত্র বিক্ষোভ পরিস্থিতি সৃস্টির ইল্পব্দনদাতা ও চক্রান্তকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ‘অপরাধ’ তারা ছাত্র বিক্ষোভের সময় ছাত্রদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখা দরকার, ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ অকারণে সৃস্টি হয়নি। এর সূত্রপাত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে, যেখানে এই শিক্ষকদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। পরে ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা নিজেরা যখন বিক্ষোভ শুরু করে তখন কিছুসংখ্যক শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিক্ষোভের ন্যায্যতা উপলব্ধি করে তাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ছাত্রদের পাশে তাদের শিক্ষকরা যদি না দাঁড়ান তাহলে শিক্ষক হিসেবে কে তাদের শ্রদ্ধা করবে? তাছাড়া এ ধরনের বিক্ষোভ আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের ঐক্য এ দেশে কোনো নতুন ব্যাপার নয়। এই সংঘর্ষের দৃস্টান্ত পাওয়া যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত অসংখ্য আন্দোলনের মধ্যে। এই সম্পর্কে এ দেশে ঐতিহ্যগতভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শক্তির জোগান দিয়েছে। সরকার এখন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষককে আটক করেছে। কিন্তু এটা খুব জোর দিয়েই বলা চলে, অল্প কিছু ব্যতিত্রক্রম ছাড়া সব শিক্ষকেরই সমর্থন ছিল এবং আছে ছাত্রদের পক্ষে।
শিক্ষকদের গ্রেফতারের সঙ্গে সম্পর্কিত যে নতুন ব্যাপার এখানে দেখা গেল তা হচ্ছে, তাদের সরাসরি জেলে না নিয়ে ৩৬ ঘণ্টা সম্পূর্ণভাবে পর্দার আড়ালে রাখা এবং তারপর তাদের আদালতে উপস্থিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪ দিন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দশদিনের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া। এ ধরনের ব্যাপার ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে ১৯৬৯-’৭১-এর আন্দোলন পর্যন্ত কোনো সময়েই দেখা যায়নি, এর চিন্তা পর্যন্ত করা যায়নি। কিন্তু পাকিস্থানিদের শাসন আমলেও যা দেখা যায়নি, সেটাই এখন দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে। এসব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা এখন কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পুলিশের রিমান্ডে ত্রিমিন্যাল চার্জে গ্রেফতারকৃত লোকদেরই নেওয়া হয়, যদিও এভাবে পুলিশ রিমান্ডে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নেওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাকিস্থান আমলে, এমনকি সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকেও এভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রিমান্ডে নেওয়ার রীতি ছিল না, থাকলেও তার দৃস্টান্ত বিরল ছিল। কিন্তু এখন যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া পরিণত হয়েছে এক অতি সাধারণ রীতিতে। একজনকে গ্রেফতার করেই তাকে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয় এবং আদালত প্রায় সব ক্ষেত্রেই রিমান্ডের মেয়াদ কিছুটা কমিয়ে আবেদন মঞ্জুর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও পুলিশের রিমান্ডের আবেদন যে আদালত মঞ্জুর করবেন এটাও এক অভাবনীয় ব্যাপার। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আরো উল্কেèখ করা দরকার যে, ঢাকা ও রাজশাহী উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই পুলিশ দশদিন করে রিমান্ডের আবেদন করে যা সাধারণত বড় ত্রিক্রমিনালদের ক্ষেত্রেও করা হয় না। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে মাননীয় আদালত ঢাকার শিক্ষকদের জন্য ৪ দিনের এবং রাজশাহীর শিক্ষকদের জন্য পুরো দশদিনের রিমান্ডই মঞ্জুর করেছেন। এসব দেখেশুনে, যাদের অন্য কিছু করার নেই তাদের পক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ধরনী দ্বিধা হও’ বলা ছাড়া আর উপায় কী?
২০ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনাবলির চক্রান্তকারী এবং উস্কানিদাতা বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু আছে এ রকম ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার যদি তাদের খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যায় তাহলে সেটা হবে অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার মতোই ব্যাপার। এর জন্য তারা যতই লোকজন গ্রেফতার করুন, তাতে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা নেই, যা নেই তা খোঁজার চেস্টা পন্ডশ্রম ছাড়া আর কী?
দেশের পরিস্থিতির যারা খোঁজখবর রাখেন এবং সত্যনিষ্ঠভাবে যারা ঘটনার বিচার করতে চান, তাদের সবারই একবাক্য হলো উপরোক্ত ওই তিনদিন যা ঘটেছে তা ষোলআনা স্বতঃম্ফূর্ত, তার মধ্যে উস্কানি, চক্রান্ত ইত্যাদির নামগন্ধ নেই। এক্ষেত্রে সত্যিকার উস্কানির সন্থান যদি করতে হয় তাহলে সেটা সত্যনিষ্ঠভাবে করা দরকার ২০ আগস্ট খেলার মাঠের ঘটনার মধ্যে। উস্কানির কথাই যদি এক্ষেত্রে বলা হয়, তাহলে ওই ঘটনার রিপোর্ট সামান্য পর্যালোচনা করলেই তাৎক্ষণিক উস্কানিদাতার পরিচয় সহজেই পাওয়া যাবে।
কোনো কিছু সমর্থন করা এবং সে ব্যাপারে উস্কানি দেওয়া এক কথা নয়। কাজেই যে শিক্ষকদের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের থেকে উস্কানি অথবা চক্রান্তের কোনো তথ্য পাওয়া যাবে এটা মনে করার কারণ নেই। রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আদর করে না এটা জানা কথা। এই শিক্ষকদেরও আদর করা হবে না।
গ্রেফতারকৃত শিক্ষকরা কোনো দুর্নীতিবাজ নন। তারা রাজনৈতিক বন্দি। কাজেই তারা সর্বতোভাবে রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। রিমান্ডে নিয়ে তাদের এই মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। এরপর রিমান্ড শেষে তাদের জেলখানায় যদি রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা না দিয়ে সাধারণ আসামির সঙ্গে রাখা হয় তাহলে তার দ্বারা গোটা জাতির মর্যাদাই ভূলুণ্ঠিত হবে। কাজেই এসব না করে পাঁচজন গ্রেফতারকৃত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া দরকার। সারাদেশের জনগণও যে এই দাবির পক্ষে এটা সহজেই বোঝা যায় এবং সংবাদপত্রে বিভিল্পু মহলের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও তার প্রমাণ মেলে।
একটি দেশে জনগণ যখন কোনো সরকারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ ও মারমুখো হয় তখন তার কারণ অবশ্যই থাকে। ‘উস্কানি তত্ত্ব’ অনুযায়ী এই কারণকে উস্কানি হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে।
বাংলাদেশে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের চরম দুর্নীতি ও জনবিরোধী নানা কাজের মাধ্যমে দেশে এক সংকটজনক পরিস্থিতির সৃস্টি করেছিল। সেই সংকট সমাধানের চেস্টার মধ্যে না গিয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ এমনভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও শত্র“ বিএনপির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছিল যাতে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে ভয়াবহ হয়েছিল। সেই ভয়াবহ অবস্থায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এ কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এদের প্রতি এক ধরনের সমর্থন জনগণের মধ্যে ছিল, যদিও এ ধরনের সরকারের স্বাভাবিক গতি কোন দিকে এ বিষয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহের অভাব ছিল না।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সাত মাস পার হলেও বাংলাদেশ যে সাধারণ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল সে সংকট তার কাটেনি, উপরন্তু আরো গভীর হয়েছে। জনগণের জীবন আগের থেকেও এখন অনেক বেশি দুর্বিষহ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য দ্রুত ও ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া; কারখানার পর কারখানা বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকারে পরিণত হওয়া; সরকারি ও বেসরকারি কারখানার লাখ লাখ শ্রমিকের মাসের পর মাস মজুরি বকেয়া থাকা ও তা পরিশোধ না করে মিল-কারখানা বল্পব্দ করা; কৃষিঋণের সুদ বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণের মহৃল্য বৃদ্ধি, কৃষককে কোনো ভর্তুকি না দেওয়া, কৃষক ফসলের ন্যায্যমহৃল্য না পাওয়া, গ্রামাঞ্চলে কাজ না থাকা; শহরে ছিল্পুমহৃল মানুষের বস্তি ও কাজের জায়গায় তাদের ওপর আক্রমণ, হকার উচ্ছেদ; ছাত্রদের বেতন-ফি বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্য এবং জরুরি অবস্থার নামে জনগণের সব ধরনের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করার দ্বারা এমন অবস্থা সারাদেশে সৃস্টি হয়েছে যার মধ্যেই জনগণকে বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো ‘উস্কানি’র উপাদান যথেস্ট আছে। কাজেই এসব দিকের মধ্যেই বিস্ফোরণের আকারে বিক্ষোভের কারণ সন্ধান করতে হবে। যেখানে এ দেশের ইতিহাসে ব্যাপকতম গণবিক্ষোভের জন্য এক লাখ বেনামী লোকের বিরুদ্ধে পুলিশকে মামলা দায়ের করতে হয় সেখানে ‘উস্কানি’র আসল উৎস কোথায় এটা বোঝার কি কোনো অসুবিধা আছে?
No comments:
Post a Comment